পোল্যান্ডে ওয়ার্ক পারমিট ভিসা সুবিধা

2849 Visited

22 Sep
পোল্যান্ডে ওয়ার্ক পারমিট ভিসা সুবিধা

শেখ মহিতুর রহমান বাবলু :: একে একে জীবিকার তাগিদে ইউরোপে আসার সব পথ বন্ধ প্রায়। অথচ তৃতীয় বিশ্বের বেকার বিশাল জনগোষ্ঠী ইউরোপ আমেরিকার দিকে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণায় কাতর চাতক পাখির মতো। অবৈধভাবে ইউরোপের পথে পাড়ি জমাতে গিয়ে ভূমধ্য সাগরে প্রায়ই নৌকাডুবিতে সলিল সমাধি হচ্ছে অজানা অচেনা হতভাগা অগণিত অভিবাসীর। গণমাধ্যমে এসব খবর দেখেও জাগ্রত হচ্ছে না বিশ্ব মানবতার। অবশ্য সম্প্রতি অভিবাসীদের জন্য নিরাপদ আবাসন কেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারে একটা সমঝোতায় পৌঁছেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। বাস্তবে সেটা কতটুকু ফলপ্রসূ হয়, তা দেখার অপেক্ষায়  সবাই।
কিছুদিন আগে জানতে পারলাম পোল্যান্ডে সহজ শর্তে জব ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসা ও ভ্রমণ ভিসা দেয়া হচ্ছে। খবরটি শুনতেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম দেশটির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে। পূর্বের পাওয়া তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিলও খুঁজে পেলাম। কথা বললাম এদেশের পোলিশ বন্ধুদের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত নিলাম পোল্যান্ড ভ্রমণের।
মধ্য ইউরোপের সার্বভৌম দেশ পোল্যান্ড। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ষষ্ঠ জনবহুল দেশ এটি। ১৬ সেঞ্চুরিতে পোল্যান্ড ইউরোপের একটি শক্তিশালী, প্রভাবশালী ও সমৃদ্ধ দেশ ছিল। এ সময় পোল্যান্ড, রাশিয়া ও সুইডেনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। কিন্তু ইউরোপীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর পররাজ্য দখলের লিপ্সা ও পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ অগণতান্ত্রিক অস্থিতিশীলতা এবং ওই অঞ্চলের রাজনীতিবিদদের লোভ, স্বার্থপরতা ও দেশপ্রেমের অভাবে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে সব ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলে দেশটি। এমনকি তার রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়। পোল্যান্ডকে পার্শ্ববর্তী দেশ রাশিয়া প্রশিয়া (জার্মান) ও সুইডেন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে যায় পোল্যান্ড নামের দেশটি।

১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পোল্যান্ড আবারও স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মমর্যাদা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৮৯ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট শাসনামলের অবসান হলে পোল্যান্ড আবারও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপ নেয়। ১৯৯৭ সালে এর নতুন সংবিধান রচিত হয়। সাবেক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পোল্যান্ড অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল। ২০০০ সালের পর বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তারও প্রভাব পড়েনি সম্ভাবনাময় এই দেশটির ওপর। 
পোল্যান্ডে শ্রমজীবীদের পারিশ্রমিক ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর চাইতে অনেক কম। সেজন্য ২০০০ সালের পর শিল্পে উন্নত ইতালিসহ ইউরোপের শিল্পে সমৃদ্ধ দেশ থেকে হাজার হাজার শিল্প কারখানা স্থানান্তর করা হয় পোল্যান্ডসহ ইস্ট ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এদিকে পোল্যান্ড ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হলে এ অঞ্চলের ২৭-২৮টা দেশের দরজা উন্মুক্ত হয় পোলিশদের জন্য। এ সুযোগে দেশটির মধ্য বয়সী ও যুবসমাজ বেশি বেশি উপার্জনের আশায় অভিবাসন শুরু করে উন্নত ইউরোপের দেশে দেশে। ফলে তীব্র শ্রমিক সংকট দেখা দেয় পোল্যান্ডে। এ সমস্যা উত্তরণে দেশটি কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, লিথুনিয়াসহ প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের জন্য তাদের শ্রমবাজারে প্রবেশের পথ শিথিল করে দেয়। কিন্তু তাতেও সংকট মোকাবিলা সম্পূর্ণভাবে সফল না হলে পোল্যান্ড তাদের রাষ্ট্রীয় ওয়েবসাইটে প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয় সবার জন্য ওয়ার্ক পারমিট ভিসা ও পার্মানেন্ট রেসিডেন্সের নানা আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধার কথা। 
লন্ডন থেকে আমরা সরাসরি উড়ে গেলাম পোল্যান্ডের রাজধানী ধিৎংধ-িতে। আমার সফরসঙ্গী লন্ডনে আমার জামাই পরিচয়ে পরিচিত  আদনান আহমেদ ও সুদর্শন বালক মো. মোকাদ্দুস টিপু। লন্ডন থেকে যাওয়ার আগে একাধিক লফার্ম, একাউন্টেন্ট ফার্ম, বাংলাদেশ মিশন ও সেদেশের বাংলাদেশ ব্যবসায়িক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সবাই আমাদের অভিনন্দন জানান। সাক্ষাতের জন্য অ্যাপয়েনমেন্ট দেন নির্দ্বিধায়। কিন্তু বাংলাদেশ দূতাবাস পোল্যান্ড এ ব্যাপারে ছিল নীরব দর্শক। বহুবার তাদের অফিসের টেলিফোন নাম্বারে রিং করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। কেউ কল রিসিভ করেনি। উপায় না দেখে দূতাবাসের ইমেইলে রাষ্ট্রদূত বরাবর চিঠি লিখি। অ্যাপ্লিকেশন করি। তাতেও ঘুম ভাঙেনি সাহেবদের। অ্যাপ্লিকেশন করার সময় আমাদের পত্রিকার অফিসিয়াল প্যাড ব্যবহার করি। যাতে আমার আইডেনটিটি নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে। সেখানে আমার পরিচয় মিটিংয়ের উদ্দেশ্য পোল্যান্ডে আমার হোটেলের ঠিকানা, আমাদের সফরসূচি সব উল্লেখ ছিল। 
ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশ মিশন ও  সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলে ইন্টারভিউ নিয়ে লন্ডন ফিরব। তার পর দেশ-বিদেশের রেডিও, টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়াতে বিস্তারিত নিউজ করলে পোল্যান্ড সম্পর্কে আগ্রহীরা উপকৃত হবে। দালাল বা আদম বেপারি দ্বারা কেউ প্রতারিত হবে না। এতে উপকৃত হবে দেশ। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের তালিকায় যোগ হবে নতুন নতুন মুখ। কিছুটা হলেও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে রক্ষা পাবে দেশ ও জাতি। আমার সে পরিকল্পনা প্রায় ভ-ুল করে দিয়েছিল বাংলাদেশ দূতাবাস পোল্যান্ড। 
বিমানবন্দর থেকে রাজধানী ওয়ারশ’র কেন্দ্রবিন্দুতে এসে হোটেলে  প্রথমে গাট্টি-বোচকা রাখার ইচ্ছা ছিল আমার। আদনান আপত্তি করল। তার বক্তব্য যে কাজে এসেছি ওটা আগে করতে হবে। আদনানের কথা রক্ষা করতে হলো। জামাই বলে কথা। আমরা সোজা গিয়ে হাজির হলাম পূর্ব নির্ধারিত একটি ল’ফার্মে। এদের সঙ্গে ইমেইলে লন্ডন থেকেই যোগাযোগ হয়েছে। আমাদের বসতে দেয়া হলো সুসজ্জিত একটা মিটিংরুমে। অফার করা হলো চা কফি ও কোমল পানীয়। টিপু বলে উঠল কিছুই চাই না, কোল্ড ওয়াটার প্লিজ। বাইরে প্রচ- গরম।  আমরা ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিলাম।  
কিছুক্ষণ পর কাগজ কলম হাতে অল্পবয়সী পোলিশ আইনজীবী আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী না হলেও তার হাসিটা ছিল বেশ। আদনান একে একে প্রশ্ন করে চলেছে। আমি আলোচনার কী পয়েন্ট নোট করছি। ফাঁকে ফাঁকে আমিও প্রশ্ন করছি। এদিকে আমাদের সুদর্শন বালক টিপু মুঠোফোনে চ্যাট নিয়ে ব্যস্ত। মনে হলো এ পৃথিবীর জাগতিক সব সম্পর্ক উপেক্ষা করে ভিন্ন গ্রহে তার অবস্থান। অজানা কোথাও হারিয়ে গেছে সে। 
মিটিং শেষ করে ট্যাক্সি নিয়ে আমরা সোজা হোটেলে। সন্ধ্যার আগে এলাকাটা হেঁটে দেখতে ও হালাল খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছি। প্রচ- শীতপ্রধান দেশ হলেও পোল্যান্ডকে সবুজের দেশ বলা হয়। জনশূন্য রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। ছবি তুলছি। উপভোগ করছি সবুজের চাদরে মোড়ানো ওয়ারশ’র উপকণ্ঠ। হঠাৎ একটা ছোট্ট ক্যানেল তার উপর সুসজ্জিত একটি ব্রিজ চোখে পড়ল। ব্রিজের রেলিংয়ে লাগানো অসংখ্য তালা। আমি বিজ্ঞের মতো হাসছি। আদনান ও টিপু তালা ও হাসার রহস্য জানতে চাইল। 
কথায় বলে ইউরোপ আমেরিকার তিন ডাবলুর কোনো ভরসা নেই। ওয়াইফ, ওয়েদার ও ওয়ার্ক। যে কোনো মুহূর্তে এরা রং বদলায়। কথাটা একশত ভাগ সত্য। একবার এক বন্ধু তার প্রথম গিন্নির সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের গল্প বলেছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তার টেবিলে তার গিন্নি বলছে,
মি. এক্স তুমি এক ঘণ্টার মধ্যে বাসা ছাড়বে। 
পুরুষটা জানতে চাইল কোনো সমস্যা?  

মহিলা- কাল রাতে তুমি আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করনি। সো প্লিজ লিভ মি নাউ। সি ইউ কোর্ট অর সলিসিটার্স অফিস। 
বন্ধুটা বলল গতকাল গভীর রাতে আমার এক্স গিন্নি মাতাল হয়ে এক বন্ধুর হেল্প নিয়ে বাসায় ফেরে। আমি তাকে ২-৩টা প্রশ্ন করেছিলাম মাত্র। 
এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকবে আমাকে বলোনি কেন?
তোমার সঙ্গের ওই লোকটি কে?
নাউ এ ডে হোয়াট ইউ আর ডুইং, ইট ইজ নট ফেয়ার।
ব্যস রেগে মেগে ক্ষিপ্ত হলো সে। বলল আমার পারসোনাল ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করছ তুমি। ইট ইজ অলসো নট ফেয়ার। টক্ টু ইউ টুমরো। 
ইউরোপের যে সব দেশে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা আকাশচুম্বি পোল্যান্ড তাদের মধ্যে অন্যতম। আদনান ও টিপুকে বললাম নবদম্পতিরা এখানে আসে, রেলিংয়ে তালা মেরে ক্যানেলকে পিছে রেখে চোখ বন্ধ করে মাথার উপর দিয়ে চাবি ছুড়ে মারে ক্যানেলের পানিতে। তারা বিশ্বাস করে এমনটি করলে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক অটুট থাকবে। টিপু জিজ্ঞাসা করল বাস্তবে কি তাই আঙ্কেল। আমি বাংলাদেশের নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের মতো দাঁত কেলিয়ে রহস্যের অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। আমার হাসির রেশ না কাটতেই টিপু তালার পাশে গিয়ে সেলফি নিতে থাকল। এ প্রতিযোগিতায় আদনানও পিছিয়ে রইল না। ওদের ভাব-সাব দেখে মনে হলো এক দুটো নয় ডজন ডজন তালা থাকলেও ওরা সেটা সেঁটে দিত রেলিংয়ের গায়ে, চাবি ছুড়ে ফেলত গভীর জলে।
সেদিন ছিল পোল্যান্ড সেনেগালের মধ্যে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা। হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছালাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অসাধারণ লীলাভূমিতে। চারিদিকে সবুজ অরণ্যে বেষ্টিত। মাঝখানে ফাঁকা একটি এলাকা।  বড় পর্দায় সেখানে চলছে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা। সামনে শত শত ইজি চেয়ার। কেউ শুয়ে, কেউ বসে গা এলিয়ে মহা আনন্দে খেলা দেখছে। আমরাও ফাঁকা দেখে বসে পড়লাম। চারিদিকে বিয়ার ও ভোটকার গন্ধ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই চুমু খাচ্ছে রঙিন পানিতে। সেনেগাল ইতোমধ্যে গোল করেছে। চারিদিকে থমথমে ভাব। বিয়ার ও মদের বিক্রি বেড়ে গেল। দর্শকদের মধ্যে নেই বাড়তি উন্মাদনা। এ দৃশ্য দেখে বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ভক্তদের কথা মনে পড়ল। মনে প্রশ্ন জাগল জাতিগতভাবে আমরা কি প্রয়োজনাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ? আমার ধারণা সঠিক হলে ভয়ঙ্কর। কারণ আবেগ যেখানে প্রবল বিবেক সেখানে অচল।
আমি খেলার জগতে ডুব মেরেছি। আদনান ইতোমধ্যে তথ্য সংগ্রহ করেছে হালাল খাবারের। আমরা ওখান থেকে রাতের খাবার সেরে হোটেলে ফিরলাম।
আমাদের হোটেল থেকে একটু দূরেই ওয়ারশ বাংলাদেশ দূতাবাস। চলতে ফিরতে চোখে পড়ত পত  পত করে উড়ছে আমার অস্তিত্বের অহংকার লালসবুজের পতাকা। আদনান ও টিপু আমাকে বারবার সেখানে যাওয়ার জন্য ইনসিস্ট করেছে। আমার মন টানেনি। বরং ওদের শিষ্টাচারের কথা মনে হতেই ব্যথায় বুকটা টন টন করেছে আমার।
পোল্যান্ডের বাকি দিনগুলো যথাক্রমে অন্য আইনজীবী, অ্যাকাউন্টেন্ট ও স্থানীয় বাংলাদেশিদের সঙ্গে ভালোই কেটেছে। রাজধানী ওয়ারশ-তে বাংলাদেশির সঠিক সংখ্যা কত কেউ বলতে পারেনি। বিশেষ কয়েকটি এলাকা ছাড়া বাংলাদেশি খুব একটা চোখেও পড়েনি। উন্নত বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে বাংলাদেশি পাড়া থাকে। ওয়ারশ-তে তারও সন্ধান মেলেনি। তবে হ্যাঁ পোল্যান্ডে বাংলাদেশি যাই থাকুক না কেন সেখানে ভারতীয়দের উপস্থিতি প্রচুর। 
পোল্যান্ড অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের ধনী দেশগুলোর তুলনায় কিছুই না। তবে সেখানকার দৃষ্টিনন্দিত আধুনিকতার ছোঁয়া মনে রাখার মতো। রাস্তার পাশে রাখা আছে সাইকেল মেরামতের যাবতীয় সরঞ্জাম। চলতি পথে সাইকেলে কোনো সমস্যা হলে তা মেরামতের ব্যবস্থা সরকারিভাবেই রাস্তায় রাস্তায় মজুদ করে রাখা আছে। ট্রেন স্টেশনে আছে পয়সার বিনিময়ে টয়লেট করার ব্যবস্থা। মজার ব্যাপার হলো টয়লেট ব্যবহার করতে হলে পে করতে হবে কন্ট্রাক্টলেস ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। ইউরোপের আর কোনো দেশে এটা দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না। এছাড়াও আধুনিকতার অনেক কিছু আছে সেখানে যা এই অল্প পরিসরে বর্ণনা করা অসম্ভব প্রায়। 
আজ আমাদের লন্ডনে ফিরতে হবে। টিপুর ঘ্যান ঘ্যানানির যন্ত্রণায় একটু আগেই এয়ারপোর্ট এলাম। আসার পথে এয়ারপোর্টের একটা স্যুভেনির শপে কি একটা আইটেম চোখে পড়েছিল টিপুর। সে ওটা কিনবে বলে কমিটমেন্ট করেছিল দোকানিকে। এয়ারপোর্টে আগে ভাগে আসার ব্যাপারে তার উচ্ছ্বাস ও কৌতূহলের এটাই কারণ। ট্রেনে চেপে এয়ারপোর্টে আসার পথে টিপুকে জিজ্ঞাসা করলাম আজ ওই আইটেমটা যদি আউট অফ স্টক হয়? দৃঢ়তার সঙ্গে সে বলল, ফ্লাইট বাতিল করব, নতুন টিকিট কাটব, প্রয়োজনে পোল্যান্ডে আরও ক’দিন থাকব। মাগার আমার ওটা চাই।
এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জে বসে আছি। আমি আর আদনান। সামনে স্পার্কিং মিনারেল ওয়াটার ও গ্রিন টি। জিজ্ঞাসা করলাম আমাদের সুদর্শন কোথায়? মিসকি হেসে আদনান বলল স্যুভেনির আঙ্কেল স্যুভেনির। একটু পরে আদনান একই পথ ধরল। আমি একা, হলাম বোকা, কি আর করার। হিসাব মিলাতে বসলাম আমাদের পোল্যান্ড ভ্রমণের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে। আদনান আর টিপু বীরের বেশে ফিরে এলো। টিপুর চোখেমুখে বিজয়ের বার্তা। ঘুষ হিসাবে আমার জন্যেও কিছু গিফট এনেছে আদনান। 
পোল্যান্ডের ওয়ার্ক পারমিট ভিসা, থাকার ও কাজের সুযোগ-সুবিধা, স্টুডেন্ট ভিসা ইত্যাদি নিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করতেই এদেশে আসা। বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কিছু প্রতারণা চক্র, দালাল ও আদম ব্যবসায়ী তৎপর হয়ে উঠেছে। সত্য মিথ্যা বুঝিয়ে তারা নিরীহ মানুষকে প্রতারিত করছে। ইউটিউবে মনগড়া ইনফরমেশন দিয়েও অনেকে মজা নিচ্ছে। এসব কিছুর ঊর্ধ্বে সত্য তথ্য  দিয়ে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোই আমার পোল্যান্ড ভ্রমণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
আইনজীবী, একাউনট্যান্ট ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল।
১. ইউরোপে যাদের ভিসার মেয়াদ আছে, তাদের জন্য পোল্যান্ডে টেম্পোরারি রেসিডেন্স পার্মিট, ফুল টাইম কাজের অনুমতি ও কাজ  খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু না।  
২. ওয়ার্ক ভিসা নিয়েও বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে পোল্যান্ডে আসা সম্ভব। তবে শর্ত হচ্ছে প্রমাণ সাপেক্ষে মালিক পক্ষ থেকে প্রথমে কর্মী খুঁজতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে সরকারি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের মাধ্যমে কর্মী খুঁজবে। এবারও ব্যর্থ হলে সরকার মালিক পক্ষকে একটা সার্টিফিকেটে প্রদান করবে। যেখানে লেখা থাকবে, উল্লিখিত কোম্পানি তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারিভাবে ও নিজের উদ্যোগে কর্মী খুঁজে ব্যর্থ হওয়ায় তারা দারুণভাবে কর্মী সংকট ঝুঁকিতে আছে। যা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের  জন্য বিপদ সংকেত। এমতাবস্থায় কোম্পানিটিকে উপরে উল্লিখিত ক্যাটাগরিতে .... জন কর্মী বহির্বিশ্ব থেকে আমদানি করার জন্য অনুমতি প্রদান হলো।
কর্মীর পাসপোর্ট কপি, মালিকের ব্যবসায়িক কাগজপত্র ও উপরে উল্লিখিত সার্টিফিকেটসহ আইনজীবী, অ্যাকাউনট্যান্ট বা মালিক পক্ষ নিজে সংশ্লিষ্ট অফিসে জমা দিলে সর্বোচ ৯০ দিনের মধ্যে এনওসি ইস্যু হবে। পরবর্তীতে কর্মী প্রয়োজনীয় কাগজ ও এনওসি পোল্যান্ড দূতাবাসে জমা দিলে পাওয়া যেতে পারে দেশটির ওয়ার্ক পারমিট ভিসা। 
৩. স্টুডেন্ট ভিসায় পোল্যান্ড এলে স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পার্মিট ও কাজের অনুমতি পাওয়া যেতে পারে। 
৪. মালিক পক্ষ কর্মীকে ফুলটাইম কাজের চুক্তি করলে কর্মী তার ফ্যামিলি নিজ দেশ থেকে পোল্যান্ডে আনার অনুমতি পাবে।
৫. পোল্যান্ডে সাধারণত প্রথমে টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পার্মিট প্রদান করা হয়। শর্ত সাপেক্ষে ৫ বছর পর আবেদন করা যায় পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট পারমিটের। এর ২ বছর পর আবেদন করা যায় নাগরিত্বের। পোল্যান্ডের নাগরিক মানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৮টি দেশের নাগরিক। সুতরাং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের যে কোনো দেশে স্থায়ীভাবে থাকা, কাজ করা, পড়াশুনা করা ও ওই দেশের সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেতে আর কোনো বাধা থাকে না। 
bablulondon@gmail.com
লেখক :শেখ মহিতুর রহমান বাবলু, লন্ডন থেকে

একে একে জীবিকার তাগিদে ইউরোপে আসার সব পথ বন্ধ প্রায়। অথচ তৃতীয় বিশ্বের বেকার বিশাল জনগোষ্ঠী ইউরোপ আমেরিকার দিকে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণায় কাতর চাতক পাখির মতো। অবৈধভাবে ইউরোপের পথে পাড়ি জমাতে গিয়ে ভূমধ্য সাগরে প্রায়ই নৌকাডুবিতে সলিল সমাধি হচ্ছে অজানা অচেনা হতভাগা অগণিত অভিবাসীর। গণমাধ্যমে এসব খবর দেখেও জাগ্রত হচ্ছে না বিশ্ব মানবতার। অবশ্য সম্প্রতি অভিবাসীদের জন্য নিরাপদ আবাসন কেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারে একটা সমঝোতায় পৌঁছেছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। বাস্তবে সেটা কতটুকু ফলপ্রসূ হয়, তা দেখার অপেক্ষায়  সবাই।
কিছুদিন আগে জানতে পারলাম পোল্যান্ডে সহজ শর্তে জব ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসা ও ভ্রমণ ভিসা দেয়া হচ্ছে। খবরটি শুনতেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম দেশটির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে। পূর্বের পাওয়া তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিলও খুঁজে পেলাম। কথা বললাম এদেশের পোলিশ বন্ধুদের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত নিলাম পোল্যান্ড ভ্রমণের।
মধ্য ইউরোপের সার্বভৌম দেশ পোল্যান্ড। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ষষ্ঠ জনবহুল দেশ এটি। ১৬ সেঞ্চুরিতে পোল্যান্ড ইউরোপের একটি শক্তিশালী, প্রভাবশালী ও সমৃদ্ধ দেশ ছিল। এ সময় পোল্যান্ড, রাশিয়া ও সুইডেনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। কিন্তু ইউরোপীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর পররাজ্য দখলের লিপ্সা ও পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ অগণতান্ত্রিক অস্থিতিশীলতা এবং ওই অঞ্চলের রাজনীতিবিদদের লোভ, স্বার্থপরতা ও দেশপ্রেমের অভাবে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে সব ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলে দেশটি। এমনকি তার রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়। পোল্যান্ডকে পার্শ্ববর্তী দেশ রাশিয়া প্রশিয়া (জার্মান) ও সুইডেন নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে যায় পোল্যান্ড নামের দেশটি।
১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পোল্যান্ড আবারও স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মমর্যাদা লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৮৯ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট শাসনামলের অবসান হলে পোল্যান্ড আবারও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপ নেয়। ১৯৯৭ সালে এর নতুন সংবিধান রচিত হয়। সাবেক কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পোল্যান্ড অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল। ২০০০ সালের পর বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তারও প্রভাব পড়েনি সম্ভাবনাময় এই দেশটির ওপর। 
পোল্যান্ডে শ্রমজীবীদের পারিশ্রমিক ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর চাইতে অনেক কম। সেজন্য ২০০০ সালের পর শিল্পে উন্নত ইতালিসহ ইউরোপের শিল্পে সমৃদ্ধ দেশ থেকে হাজার হাজার শিল্প কারখানা স্থানান্তর করা হয় পোল্যান্ডসহ ইস্ট ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এদিকে পোল্যান্ড ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হলে এ অঞ্চলের ২৭-২৮টা দেশের দরজা উন্মুক্ত হয় পোলিশদের জন্য। এ সুযোগে দেশটির মধ্য বয়সী ও যুবসমাজ বেশি বেশি উপার্জনের আশায় অভিবাসন শুরু করে উন্নত ইউরোপের দেশে দেশে। ফলে তীব্র শ্রমিক সংকট দেখা দেয় পোল্যান্ডে। এ সমস্যা উত্তরণে দেশটি কাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, লিথুনিয়াসহ প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের জন্য তাদের শ্রমবাজারে প্রবেশের পথ শিথিল করে দেয়। কিন্তু তাতেও সংকট মোকাবিলা সম্পূর্ণভাবে সফল না হলে পোল্যান্ড তাদের রাষ্ট্রীয় ওয়েবসাইটে প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয় সবার জন্য ওয়ার্ক পারমিট ভিসা ও পার্মানেন্ট রেসিডেন্সের নানা আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধার কথা। 
লন্ডন থেকে আমরা সরাসরি উড়ে গেলাম পোল্যান্ডের রাজধানী ধিৎংধ-িতে। আমার সফরসঙ্গী লন্ডনে আমার জামাই পরিচয়ে পরিচিত  আদনান আহমেদ ও সুদর্শন বালক মো. মোকাদ্দুস টিপু। লন্ডন থেকে যাওয়ার আগে একাধিক লফার্ম, একাউন্টেন্ট ফার্ম, বাংলাদেশ মিশন ও সেদেশের বাংলাদেশ ব্যবসায়িক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সবাই আমাদের অভিনন্দন জানান। সাক্ষাতের জন্য অ্যাপয়েনমেন্ট দেন নির্দ্বিধায়। কিন্তু বাংলাদেশ দূতাবাস পোল্যান্ড এ ব্যাপারে ছিল নীরব দর্শক। বহুবার তাদের অফিসের টেলিফোন নাম্বারে রিং করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। কেউ কল রিসিভ করেনি। উপায় না দেখে দূতাবাসের ইমেইলে রাষ্ট্রদূত বরাবর চিঠি লিখি। অ্যাপ্লিকেশন করি। তাতেও ঘুম ভাঙেনি সাহেবদের। অ্যাপ্লিকেশন করার সময় আমাদের পত্রিকার অফিসিয়াল প্যাড ব্যবহার করি। যাতে আমার আইডেনটিটি নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে। সেখানে আমার পরিচয় মিটিংয়ের উদ্দেশ্য পোল্যান্ডে আমার হোটেলের ঠিকানা, আমাদের সফরসূচি সব উল্লেখ ছিল। 
ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশ মিশন ও  সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে কথা বলে ইন্টারভিউ নিয়ে লন্ডন ফিরব। তার পর দেশ-বিদেশের রেডিও, টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়াতে বিস্তারিত নিউজ করলে পোল্যান্ড সম্পর্কে আগ্রহীরা উপকৃত হবে। দালাল বা আদম বেপারি দ্বারা কেউ প্রতারিত হবে না। এতে উপকৃত হবে দেশ। রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের তালিকায় যোগ হবে নতুন নতুন মুখ। কিছুটা হলেও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে রক্ষা পাবে দেশ ও জাতি। আমার সে পরিকল্পনা প্রায় ভ-ুল করে দিয়েছিল বাংলাদেশ দূতাবাস পোল্যান্ড। 
বিমানবন্দর থেকে রাজধানী ওয়ারশ’র কেন্দ্রবিন্দুতে এসে হোটেলে  প্রথমে গাট্টি-বোচকা রাখার ইচ্ছা ছিল আমার। আদনান আপত্তি করল। তার বক্তব্য যে কাজে এসেছি ওটা আগে করতে হবে। আদনানের কথা রক্ষা করতে হলো। জামাই বলে কথা। আমরা সোজা গিয়ে হাজির হলাম পূর্ব নির্ধারিত একটি ল’ফার্মে। এদের সঙ্গে ইমেইলে লন্ডন থেকেই যোগাযোগ হয়েছে। আমাদের বসতে দেয়া হলো সুসজ্জিত একটা মিটিংরুমে। অফার করা হলো চা কফি ও কোমল পানীয়। টিপু বলে উঠল কিছুই চাই না, কোল্ড ওয়াটার প্লিজ। বাইরে প্রচ- গরম।  আমরা ভীষণ তৃষ্ণার্ত ছিলাম।  
কিছুক্ষণ পর কাগজ কলম হাতে অল্পবয়সী পোলিশ আইনজীবী আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী না হলেও তার হাসিটা ছিল বেশ। আদনান একে একে প্রশ্ন করে চলেছে। আমি আলোচনার কী পয়েন্ট নোট করছি। ফাঁকে ফাঁকে আমিও প্রশ্ন করছি। এদিকে আমাদের সুদর্শন বালক টিপু মুঠোফোনে চ্যাট নিয়ে ব্যস্ত। মনে হলো এ পৃথিবীর জাগতিক সব সম্পর্ক উপেক্ষা করে ভিন্ন গ্রহে তার অবস্থান। অজানা কোথাও হারিয়ে গেছে সে। 
মিটিং শেষ করে ট্যাক্সি নিয়ে আমরা সোজা হোটেলে। সন্ধ্যার আগে এলাকাটা হেঁটে দেখতে ও হালাল খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছি। প্রচ- শীতপ্রধান দেশ হলেও পোল্যান্ডকে সবুজের দেশ বলা হয়। জনশূন্য রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। ছবি তুলছি। উপভোগ করছি সবুজের চাদরে মোড়ানো ওয়ারশ’র উপকণ্ঠ। হঠাৎ একটা ছোট্ট ক্যানেল তার উপর সুসজ্জিত একটি ব্রিজ চোখে পড়ল। ব্রিজের রেলিংয়ে লাগানো অসংখ্য তালা। আমি বিজ্ঞের মতো হাসছি। আদনান ও টিপু তালা ও হাসার রহস্য জানতে চাইল। 
কথায় বলে ইউরোপ আমেরিকার তিন ডাবলুর কোনো ভরসা নেই। ওয়াইফ, ওয়েদার ও ওয়ার্ক। যে কোনো মুহূর্তে এরা রং বদলায়। কথাটা একশত ভাগ সত্য। একবার এক বন্ধু তার প্রথম গিন্নির সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের গল্প বলেছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তার টেবিলে তার গিন্নি বলছে,
মি. এক্স তুমি এক ঘণ্টার মধ্যে বাসা ছাড়বে। 
পুরুষটা জানতে চাইল কোনো সমস্যা? 
মহিলা- কাল রাতে তুমি আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করনি। সো প্লিজ লিভ মি নাউ। সি ইউ কোর্ট অর সলিসিটার্স অফিস। 
বন্ধুটা বলল গতকাল গভীর রাতে আমার এক্স গিন্নি মাতাল হয়ে এক বন্ধুর হেল্প নিয়ে বাসায় ফেরে। আমি তাকে ২-৩টা প্রশ্ন করেছিলাম মাত্র। 
এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকবে আমাকে বলোনি কেন?
তোমার সঙ্গের ওই লোকটি কে?
নাউ এ ডে হোয়াট ইউ আর ডুইং, ইট ইজ নট ফেয়ার। ব্যস রেগে মেগে ক্ষিপ্ত হলো সে। বলল আমার পারসোনাল ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করছ তুমি। ইট ইজ অলসো নট ফেয়ার। টক্ টু ইউ টুমরো। 
ইউরোপের যে সব দেশে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনা আকাশচুম্বি পোল্যান্ড তাদের মধ্যে অন্যতম। আদনান ও টিপুকে বললাম নবদম্পতিরা এখানে আসে, রেলিংয়ে তালা মেরে ক্যানেলকে পিছে রেখে চোখ বন্ধ করে মাথার উপর দিয়ে চাবি ছুড়ে মারে ক্যানেলের পানিতে। তারা বিশ্বাস করে এমনটি করলে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক অটুট থাকবে। টিপু জিজ্ঞাসা করল বাস্তবে কি তাই আঙ্কেল। আমি বাংলাদেশের নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের মতো দাঁত কেলিয়ে রহস্যের অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। আমার হাসির রেশ না কাটতেই টিপু তালার পাশে গিয়ে সেলফি নিতে থাকল। এ প্রতিযোগিতায় আদনানও পিছিয়ে রইল না। ওদের ভাব-সাব দেখে মনে হলো এক দুটো নয় ডজন ডজন তালা থাকলেও ওরা সেটা সেঁটে দিত রেলিংয়ের গায়ে, চাবি ছুড়ে ফেলত গভীর জলে।
সেদিন ছিল পোল্যান্ড সেনেগালের মধ্যে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা। হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছালাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অসাধারণ লীলাভূমিতে। চারিদিকে সবুজ অরণ্যে বেষ্টিত। মাঝখানে ফাঁকা একটি এলাকা।  বড় পর্দায় সেখানে চলছে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা। সামনে শত শত ইজি চেয়ার। কেউ শুয়ে, কেউ বসে গা এলিয়ে মহা আনন্দে খেলা দেখছে। আমরাও ফাঁকা দেখে বসে পড়লাম। চারিদিকে বিয়ার ও ভোটকার গন্ধ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই চুমু খাচ্ছে রঙিন পানিতে। সেনেগাল ইতোমধ্যে গোল করেছে। চারিদিকে থমথমে ভাব। বিয়ার ও মদের বিক্রি বেড়ে গেল। দর্শকদের মধ্যে নেই বাড়তি উন্মাদনা। এ দৃশ্য দেখে বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ভক্তদের কথা মনে পড়ল। মনে প্রশ্ন জাগল জাতিগতভাবে আমরা কি প্রয়োজনাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ? আমার ধারণা সঠিক হলে ভয়ঙ্কর। কারণ আবেগ যেখানে প্রবল বিবেক সেখানে অচল।
আমি খেলার জগতে ডুব মেরেছি। আদনান ইতোমধ্যে তথ্য সংগ্রহ করেছে হালাল খাবারের। আমরা ওখান থেকে রাতের খাবার সেরে হোটেলে ফিরলাম।
আমাদের হোটেল থেকে একটু দূরেই ওয়ারশ বাংলাদেশ দূতাবাস। চলতে ফিরতে চোখে পড়ত পত  পত করে উড়ছে আমার অস্তিত্বের অহংকার লালসবুজের পতাকা। আদনান ও টিপু আমাকে বারবার সেখানে যাওয়ার জন্য ইনসিস্ট করেছে। আমার মন টানেনি। বরং ওদের শিষ্টাচারের কথা মনে হতেই ব্যথায় বুকটা টন টন করেছে আমার।
পোল্যান্ডের বাকি দিনগুলো যথাক্রমে অন্য আইনজীবী, অ্যাকাউন্টেন্ট ও স্থানীয় বাংলাদেশিদের সঙ্গে ভালোই কেটেছে। রাজধানী ওয়ারশ-তে বাংলাদেশির সঠিক সংখ্যা কত কেউ বলতে পারেনি। বিশেষ কয়েকটি এলাকা ছাড়া বাংলাদেশি খুব একটা চোখেও পড়েনি। উন্নত বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোতে বাংলাদেশি পাড়া থাকে। 

ওয়ারশ-তে তারও সন্ধান মেলেনি। তবে হ্যাঁ পোল্যান্ডে বাংলাদেশি যাই থাকুক না কেন সেখানে ভারতীয়দের উপস্থিতি প্রচুর। 
পোল্যান্ড অর্থনৈতিকভাবে ইউরোপের ধনী দেশগুলোর তুলনায় কিছুই না। তবে সেখানকার দৃষ্টিনন্দিত আধুনিকতার ছোঁয়া মনে রাখার মতো। রাস্তার পাশে রাখা আছে সাইকেল মেরামতের যাবতীয় সরঞ্জাম। চলতি পথে সাইকেলে কোনো সমস্যা হলে তা মেরামতের ব্যবস্থা সরকারিভাবেই রাস্তায় রাস্তায় মজুদ করে রাখা আছে। ট্রেন স্টেশনে আছে পয়সার বিনিময়ে টয়লেট করার ব্যবস্থা। মজার ব্যাপার হলো টয়লেট ব্যবহার করতে হলে পে করতে হবে কন্ট্রাক্টলেস ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে। ইউরোপের আর কোনো দেশে এটা দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না। এছাড়াও আধুনিকতার অনেক কিছু আছে সেখানে যা এই অল্প পরিসরে বর্ণনা করা অসম্ভব প্রায়। 
আজ আমাদের লন্ডনে ফিরতে হবে। টিপুর ঘ্যান ঘ্যানানির যন্ত্রণায় একটু আগেই এয়ারপোর্ট এলাম। আসার পথে এয়ারপোর্টের একটা স্যুভেনির শপে কি একটা আইটেম চোখে পড়েছিল টিপুর। সে ওটা কিনবে বলে কমিটমেন্ট করেছিল দোকানিকে। এয়ারপোর্টে আগে ভাগে আসার ব্যাপারে তার উচ্ছ্বাস ও কৌতূহলের এটাই কারণ। ট্রেনে চেপে এয়ারপোর্টে আসার পথে টিপুকে জিজ্ঞাসা করলাম আজ ওই আইটেমটা যদি আউট অফ স্টক হয়? দৃঢ়তার সঙ্গে সে বলল, ফ্লাইট বাতিল করব, নতুন টিকিট কাটব, প্রয়োজনে পোল্যান্ডে আরও ক’দিন থাকব। মাগার আমার ওটা চাই।
এয়ারপোর্টের ভিআইপি লাউঞ্জে বসে আছি। আমি আর আদনান। সামনে স্পার্কিং মিনারেল ওয়াটার ও গ্রিন টি। জিজ্ঞাসা করলাম আমাদের সুদর্শন কোথায়? মিসকি হেসে আদনান বলল স্যুভেনির আঙ্কেল স্যুভেনির। একটু পরে আদনান একই পথ ধরল। আমি একা, হলাম বোকা, কি আর করার। হিসাব মিলাতে বসলাম আমাদের পোল্যান্ড ভ্রমণের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে। আদনান আর টিপু বীরের বেশে ফিরে এলো। টিপুর চোখেমুখে বিজয়ের বার্তা। ঘুষ হিসাবে আমার জন্যেও কিছু গিফট এনেছে আদনান। 
পোল্যান্ডের ওয়ার্ক পারমিট ভিসা, থাকার ও কাজের সুযোগ-সুবিধা, স্টুডেন্ট ভিসা ইত্যাদি নিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করতেই এদেশে আসা। বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কিছু প্রতারণা চক্র, দালাল ও আদম ব্যবসায়ী তৎপর হয়ে উঠেছে। সত্য মিথ্যা বুঝিয়ে তারা নিরীহ মানুষকে প্রতারিত করছে। ইউটিউবে মনগড়া ইনফরমেশন দিয়েও অনেকে মজা নিচ্ছে। এসব কিছুর ঊর্ধ্বে সত্য তথ্য  দিয়ে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোই আমার পোল্যান্ড ভ্রমণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
আইনজীবী, একাউনট্যান্ট ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল।
১. ইউরোপে যাদের ভিসার মেয়াদ আছে, তাদের জন্য পোল্যান্ডে টেম্পোরারি রেসিডেন্স পার্মিট, ফুল টাইম কাজের অনুমতি ও কাজ  খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু না।  
২. ওয়ার্ক ভিসা নিয়েও বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে পোল্যান্ডে আসা সম্ভব। তবে শর্ত হচ্ছে প্রমাণ সাপেক্ষে মালিক পক্ষ থেকে প্রথমে কর্মী খুঁজতে হবে। এতে ব্যর্থ হলে সরকারি সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের মাধ্যমে কর্মী খুঁজবে। এবারও ব্যর্থ হলে সরকার মালিক পক্ষকে একটা সার্টিফিকেটে প্রদান করবে। যেখানে লেখা থাকবে, উল্লিখিত কোম্পানি তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারিভাবে ও নিজের উদ্যোগে কর্মী খুঁজে ব্যর্থ হওয়ায় তারা দারুণভাবে কর্মী সংকট ঝুঁকিতে আছে। যা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের  জন্য বিপদ সংকেত। এমতাবস্থায় কোম্পানিটিকে উপরে উল্লিখিত ক্যাটাগরিতে .... জন কর্মী বহির্বিশ্ব থেকে আমদানি করার জন্য অনুমতি প্রদান হলো।
কর্মীর পাসপোর্ট কপি, মালিকের ব্যবসায়িক কাগজপত্র ও উপরে উল্লিখিত সার্টিফিকেটসহ আইনজীবী, অ্যাকাউনট্যান্ট বা মালিক পক্ষ নিজে সংশ্লিষ্ট অফিসে জমা দিলে সর্বোচ ৯০ দিনের মধ্যে এনওসি ইস্যু হবে। পরবর্তীতে কর্মী প্রয়োজনীয় কাগজ ও এনওসি পোল্যান্ড দূতাবাসে জমা দিলে পাওয়া যেতে পারে দেশটির ওয়ার্ক পারমিট ভিসা। 
৩. স্টুডেন্ট ভিসায় পোল্যান্ড এলে স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পার্মিট ও কাজের অনুমতি পাওয়া যেতে পারে। 
৪. মালিক পক্ষ কর্মীকে ফুলটাইম কাজের চুক্তি করলে কর্মী তার ফ্যামিলি নিজ দেশ থেকে পোল্যান্ডে আনার অনুমতি পাবে।
৫. পোল্যান্ডে সাধারণত প্রথমে টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পার্মিট প্রদান করা হয়। শর্ত সাপেক্ষে ৫ বছর পর আবেদন করা যায় পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট পারমিটের। এর ২ বছর পর আবেদন করা যায় নাগরিত্বের। পোল্যান্ডের নাগরিক মানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৮টি দেশের নাগরিক। সুতরাং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের যে কোনো দেশে স্থায়ীভাবে থাকা, কাজ করা, পড়াশুনা করা ও ওই দেশের সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পেতে আর কোনো বাধা থাকে না। 
bablulondon@gmail.com
লেখক : Editor : Newslife24.com