শেখ মহিতুর রহমান বাবলুকে ধরে রাখার মতো আনুকুল্য আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি।

703 Visited

22 Sep
শেখ মহিতুর রহমান বাবলুকে ধরে রাখার মতো আনুকুল্য আমরা সৃষ্টি করতে পারিনি।

 তাহমিনা ইয়াসমিন শশী, ভেনিস ইতালী ::  আশরাফুল মাখলুকাত, অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব। পরমকরুনাময় মহান আল্লাহ্ তাঁর সৃষ্টি সব জীবের মধ্য মানুষকে আলাদা করে তৈরী করছেন। দিয়েছেন শ্রেষ্ঠত্ব। সব জীবের কম বেশি বুদ্ধি বিবেচনা আছে, কিন্তু মানুষের বুদ্ধি বিবেচনা একদম অন্য রকম। যার সাথে অন্য কোনো প্রাণীর জ্ঞান বুদ্ধি বিবেচনার তুলনা হয় না। মানুষ তার বিবেক বিবেচনা, জ্ঞান বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে এই ধরণীকে করছে বাসযোগ্য। মোহনীয় করেছে জনপদ। করছে অনেক বেশী তাৎপর্যপূর্ন। আদিযুগে মানুষ থাকত বস্ত্রহীন, খেতো কাঁচা ফলমূল আর কাঁচা মাংস। ধিরে ধিরে মানুষ তার নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে গাছের বাকল দিয়ে শরীর ঢাকতে শিখেছে। বিদ্যুৎ চমকানো দেখে আগুন ধরাতে শিখেছে। সেই আগুনে কাঁচা মাংস ঝলসে খেতে শিখেছে। এভাবেই বিবর্তন এসেছে। মানুষ তার জ্ঞান বুদ্ধি খাটিয়ে বৈরীতাতে নিজেদের অনুকুলে এসেছে। মানুষ এখন আর গাছের বাকল দিয়ে শরীর ঢাকেনা। পাথর ঠুকে আগুন ধরায় না। আধুনিক প্রযুক্তির আবিষ্কার মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। পোষাকে আশাকে, খাবারে রান্নায় মানুষ এখন অনেক আধুনিক। মানুষ তার জ্ঞান বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে চাঁদ ছুঁয়েছে।
প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে ছুুটে চলেছে নিত্যনতুন আবিষ্কারে। সব আবিষ্কার যে মানুষের জন্য কল্যান বয়ে এনেছে তা কিন্তু না। আবার সব আধুনিকতা যে মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে তাও না। মানুষ তার জ্ঞান বুদ্ধির সুস্থ চর্চা করে যেমন অনেক কল্যান সাধন করেছে, তেমনি এর অশুদ্ধ চর্চা করে অনেক অকল্যানও করেছে। যারা খোদার দান জ্ঞান বুদ্ধির শুদ্ধ চর্চা করে তারা হয় সত্যিকারের আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষের কল্যানে সমাজকে দিতে পারে অনেক কিছু। তারা পূরণ করতে পারে তাদের জন্মের অঙ্গিকার।
অনেক দিন ধরে ভাবছি আর লিখব না। লিখালিখি বোধ হয় আমার জন্য না। হঠাৎ কথা হলো লিখনীর সম্পাদক শাহ্ ইফতেকার তারিক ভাইর সাথে। তিনি জানালেন, বিভিন্ন স্তর থেকে সত্যিকারের সফল মানুষদের নিয়ে লিখনী কাজ করতে যাচ্ছে। আমি যেহেতু ইতালিতে থাকি তিনি আমাকে বললেন, ইতালিতে প্রবাসী কোনও সফল প্রবাসীকে নিয়ে লিখতে। সজ্জন তারিক ভাইর কথা শুনে আমি কেমন যেন বদলে গেলাম। ওনার মাধুর্য এবং গাম্ভির্যপূর্ণ কথা পিঠে ‘না’ বলা তো দুরের কথা দ্বিমত করাও সম্ভব না। মনটা মুহুর্তেই ভালো হয়ে গেল। নতুন করে লিখার উৎসাহ পেলাম। কিন্তু কি লিখবো? কাকে নিয়ে লিখবো? প্রবাসে তো অনেক সফল মানুষ আছেন। আমি মনে করি প্রবাসের প্রতিটা মানুষই এক একজন সফল মানুষ। তারা প্রত্যেকে নিজ নিক জায়গা থেকে সফল। নিজের চেষ্টায় প্রবাসী হয়ে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে প্রতিমাসে যারা লাখ লাখ ইউরো ডলার পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তারা সফল নয়তো কে সফল? কে আছে তাদের চেয়ে বেশি সফল মানুষ? কেউ আছে বলে আমি মনে করি না। তার পরেও কথা থেকে যায়, সবাইকে নিয়ে তো আর পত্রিকার পাতায়, বইয়ের পাতায় লিখা যায় না, লিখা হয় না। যারা সৃষ্টিকর্তার দেয়া জ্ঞান বুদ্ধির শুদ্ধ চর্চা করে সমাজকে ব্যতিক্রম কিছু দিয়েছেন, দিতে পেরেছেন, দেয়ার চেষ্টা করছেন এমন মানুষকে নিয়েই পত্রিকায় লিখা হয়, লিখা উচিৎ।
কে সেই ব্যক্তি? ইতালিতে প্রবাসী একজন বিশেষ ব্যক্তিকে নিয়ে লিখার অদম্য প্রয়াস ছিল আমার অনেক দিনের। ভাবলাম এটাই সঠিক সময় এবং সুযোগ তাকে নিয়ে লিখার। কিন্তু তার সম্পর্কে কতোটুকু জানি আমি? লিখার মতো যতেষ্ঠ তথ্য উপাত্য কি আছে আমার ক্ষুদ্র ভান্ডারে? হয়তো নেই। তার মতো একজন বিশাল এবং বহুমুখি প্রতিভার মানুষকে নিয়ে লিখতে হলে যতোটা উপাত্য থাকা চাই তার খুব সামান্যই আছে আমার ভান্ডারে। তবু কোনো ভাবেই নিজেকে সংবরণ করতে পারলাম না। যেটুকু যা আছে তাই নিয়েই ঝাপিয়ে পড়লাম ল্যাপটপের উপর। এক্ষেত্রে গুগল সার্চ ইনজিন আমাকে অনেকটা সহযোগিতা করলো।

বিশেষ এই ব্যাক্তিত্বের সাথে আমার পরিচয় একটু অন্য ভাবে। সাধারণ দশজনের সাথে যে ভাবে পরিচয় হয় ঠিক সে ভাবে না। একেবারেই অন্য ভাবে। বিশেষ মানুষদের সাথে বুঝি বিশেষ ভাবেই পরিচয় হয়। আমারও তাই হয়েছে। আমি তখন ড্রাইভিং স্কুলের ছাত্রী। সম্পূর্ন ইতালীয়ান ভাষায় পড়াশোনা এবং পরীক্ষা দিতে হবে। ইতালীতে ড্রাইভিং পরীক্ষায় পাশ করা আসলেই দূরহ একটা ব্যাপার। শুধু যে অভিবাসীদের জন্য তা না, শতশত ইতালীয়ানকেও দেখেছি ডাব্বা মারতে। প্রথমে থিওরিক্যল পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। তার পর প্রাকটিক্যল পরীক্ষা। একচুল এদিক ওদিক হওয়ার উপায় নেই। ইতালিতে গাড়ি চালাতে হলে এদেশের জটিল ট্রাফিক নিয়ম কানুন জেনে বুঝে পরীক্ষায় পাশ করে লাইসেন্স নিতে হবে। বাংলাদেশের মতো বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেই। থাকলেও ওপথে কেউ যেতো বলে মনে হয় না। কারন এরা অনেক বেশি সচেতন। এরা বোঝে ড্রাইভিং পরীক্ষায় ফাঁকি দেয়া মানে নিজেকে ফাঁকি দেয়া। নিজের সাথে প্রতারণা করা। নিজের জীবন ঝুকির মধ্যে ফেলে দেয়া। এমন ভুল ইতালীয়ানরা করে না, করতে পারে না। সে যাই হোক- সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা একটি বিদেশি ভাষায় পড়াশুনা করে ইতালীয় ড্রাইভিং পরীক্ষায় পাশ করা সত্যিই কঠিন কাজ। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য আরো বেশি কঠিন।

কারন আমাদের দেশের মানুষরা এতো এতো টাকা খরচ করে, হৃণের বোঝা মাথায় নিয়ে বিদেশে আসে যে টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতেই তাদের সময় পার হয়ে যায়। অন্যদিকে খেয়াল দেয়ার সময় হয় না। স্বাভাবিক ভাবেই তারা ইতালীয় ভাষা আয়েত্ব করার দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে। ইউরোপে একবার যদি কোনো কিছুেত পিছিয়ে পড়া হয়, তবে তা কাটিয়ে উঠা সত্যিই কঠিন কাজ। তখন তারা আর সামনে আগাতে পারবে না, ধারাবাহিক ভাবে শুধু পেছাতেই থাকে। ইতালীতে আমাদের প্রবাসী কমিউনিটির অবস্থাও অনেকটা এরকম। শুধুমাত্র ভাষার দিক থেকে পিছিয়ে যাওয়ার কারনে তারা অনেক কিছু থেকে পিছিয়ে থাকে। ড্রাইভিং পরীক্ষায় ভর্তি হতে ভয় পায়। ভর্তি হলেও কৃতকার্য হতে পারে না। এতো জটিল আইন কানুন ইতালীয় ভাষায় পড়াশুনা করে পাশ করতে না পেরে গাড়ী চালানো তাদের কাছে স্বপ্নই থেকে যায়। শুরু হয় তাদের পিছিয়ে পড়া। কারন ইউরোপে গাড়ী চালানো কোনো বিলাসিতা নয়, প্রয়োজন। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার কারনে ভালো বেতনের কাজ, শহরের বাইরে কমদামে ভালো বাসায় থাকার সুযোগ সুবিধাসহ অনেক কিছু হারাতে হয়। ইতালীয় ভাষায় আমার মোটামুটি ভালোই দখল আছে। আমি এখানে দোভাষী হিসেবে কাজ করি। সুতরাং বলাই যায় অনেকের চেয়ে ভালো ভাষা জানি।

তারপেরও ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তী হয়ে দেখলাম অনেক কিছু বুঝতে আমার অসুবিধা হচ্ছে। অনেক কিছুতে হিমশিম খাচ্ছি। তখনি আমার সাথে একটু অন্যরকম ভাবে পরিচয় হয় এই বিশেষ মানুষটির। যিনি আমার মতো লাখো প্রবাসী বাংলাদেশির অসুবিধাকে সুবিধা করে দিয়েছেন। এই সফল এবং বিশেষ মানুষটির সাথে আমার কখনো সামনা-সামনি পরিচয় হয়নি। তার সাথে আমার পরিচয় তার অসাধারণ কর্ম দিয়ে। অমূল্য সৃষ্টি দিয়ে। তার সেই সৃষ্টি সাফল্যের কথাই এখানে তুলে ধরছি।

শেখ মহিতুর রহমান বাবলু। ইতালীয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স এবি বইয়ের লেখক। একাধারে তিনি সাংবাদিক, উপস্থাপক এবং ইতালীয়ান ফুড গবেষক। তার লেখা বই ইতালীয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স এবি ইতালী প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য রক্ষাকবজ হিসাবে কাজ করছে। প্রবাসীদের জীবন গতিশীল করতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তার অসাধারণ সৃষ্টি গৌরবে গোটা কমিউনিটি আজ গৌরব বোধ করে। আমরা মাথা উচু করে বলতে পারি, ইতালীতেও আমাদের ভাষায় বই আছে। ইতালীয় প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে বাংলা ভাষার অসাধারণ ড্রাইভিং বই। যে বইকে ইতালীয় সরকার স্বীকৃতি প্রদান করেছে। এখন পর্যন্ত ইতালীয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স এবি ইতালীতে একমাত্র বিদেশি ভাষায় বই যা ইতালীয় সরকার কর্তৃক অনুমোদন পেয়েছে।

শিল্পনগরী খুলনার সোনাডাঙ্গায় ১৯৬৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী জন্মগ্রহন করেন জন্মসূত্রে বাংলাদেশি এই ইতালীয়ান নাগরিক শেখ মহিতুর রহমান বাবলু। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সয়ম তিনি কাটিয়েছেন তার জন্মভূমি বাংলাদেশে। বাবা শেখ নাছরুর রহমান একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী ডাক্তার। মা কাজী সালেহা রহমান গৃহিনী। লেখালেখির জগতে বাবলুর আগমন ছেলেবেলা থেকে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিন পেরিয়ে তিনি যায়গা করে নেন দেশের একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে। এরপর নিয়োমিত লিখেছেন বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিকে। লেখা ও সাংবাদিকতার বাইরে তিনি একজন সফল সংগঠক, উপস্থাপক, সৌখিন ফটোগ্রাফার ও ইতালীয়ান ফুড গবেষক। তার একাধিক গবেষনাপত্র ইতালীর বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে অনেক বার। ছাত্র জীবনে বাবলু একজন ভালো ফুটবলার ছিলেন। ভালো গান করতেন। খুলনার বেতারে নিয়োমিত অনুষ্ঠান করতেন। এছাড়াও দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন দীর্ঘ সময়। ১৯৮৭ সালে তিনি ব্যাবসায়িক কাজে আসেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ সুইজারল্যান্ডে। এরপর আর দেশে ফিরে যান নি। তিনি সুইজারল্যান্ডে দীর্ঘ ৫ বছর অবস্থান করেন। সেখান থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকা ২০০০ সালে লিখালিখির জন্য তাকে একটি সম্মান সূচক আন্তর্জাতিক এ্যওয়ার্ড প্রদান করে।
৯০ এর দশকে বাবলু সুইজারল্যান্ড ছেড়ে চলে আসেন প্রাচীন সভ্যতার দেশ ইতালীতে। প্রথমে নোঙ্গর করেন রাজধানী রোমে। তার মন সেখানে টেকেনি। তিনি চলে যান ইতালীর অন্যপ্রান্তে। আল্পস পর্বতের পাদদেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লিলাভূমি বোলছানো শহরে। তিনি সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকের ইউরোপ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। রোম ও জুরিখ থেকে প্রকাশিত আরও দুটি পত্রিকায় তখন তিনি নিয়োমিত কলাম লেখেন। প্রবাসের নানা বৈরীতার মোকাবিলা করে নিজেকে সাফল্যের চুড়ায় নিয়ে যেতে অনেক লড়াই করেছেন বাবলু। জটিল ব্যাকারণের ইতালীয়ান ভাষাকে খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছেন। আদালতে, হাসপাতালে, পুলিশ ফাঁড়িতে দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন। বোলজানোর এক সময়ের জনপ্রিয় Radio vox- এ তার হাত ধরেই বাংলা অনুষ্ঠান চালু হয়। তিনি ভেনিসের Radio Base’র বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন কিছু সময়। ইতালীয়ান ফুডের উপর উচ্চ ডিগ্রী নিয়েছেন স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একটি পাঁচতারা হোটেলে শেফের দায়িত্বও পালন করেছেন দীর্ঘ দিন।
এতো কিছু করেও তিনি তৃপ্ত ছিলেন না। ক্লান্তিও তাকে স্পর্শ করেনি কোনো দিন। মানুষের জীবনে সফলতা তো কতো ভাবেই আসতে পারে। কেউ ব্যাবসা করে সফল হয়। কেউ কবিতা লেখে। কেউ হয় ডাক্তার, বৈজ্ঞানিক আরো কতো কি! কিন্তু বাবলুর সফলতা একটু ভিন্ন রকম। একটু অন্যরকম। এমন সফলতা খুব কম মানুষের ভাগ্যে জোটে বলে আমি মনে করি। সারাদিনের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে বাবলু নিজের পরিবারকে সময় না দিয়ে ব্যাস্ত থেকেছেন তার লিখালিখি আর গবেষনা নিয়ে। প্রবাসে বেড়ে উঠা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে তার ভাবনার অন্ত ছিলো না। তার ভয় ছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতির চাপে শিশুরা শেকড় ভুলে যাবে। এমনকি মাতৃভাষা থেকেও তারা দুরে সরে যাবে। এই আশংকা থেকে তিনি বোলজানোয় নজরুল বাংলা বিদ্যাপিঠ নামে একটি বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে প্রবাসী শিশু কিশোরদের মাতৃভাষা শিক্ষা দেয়া হতো। তার বাংলা স্কুলকে সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসে বোলজানোর বহুজাতিক সংগঠন, এসোসিয়েশন ইন্টিগ্রেশন। পরে প্রায় ১৮টি দেশের প্রতিনিধিদের ভোটে তিনি এই সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন।

বহুগুনে গুনান্বিত এই মানুষটি বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে, পুলিশের দপ্তরে যেতেন ভাষা ট্রান্সলেট করার জন্য। সে সব জায়গায় গিয়ে তিনি দেখেছেন ইতালীতে প্রবাসী বহু বাংলাদেশি মানুষ সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায়। পঙ্গুত্ব বরণ করে। এসব দেখে তিনি নিজের মধ্যে এক প্রকারের তাগিত বোধ করেন। খোজ-খবর নিতে শুরু করেন সড়ক দূর্ঘটনায় এতো মানুষের মৃত্যুর কারন কি? তিনি জানতে পারেন, কঠিন হওয়ার কারনে তখন কোনো বাংলাদেশি ইতালীয়ান ড্রাইভিং স্কুলে যেতো না। তারা বাংলাদেশ থেকে লাইসেন্স কিনে এনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে গিয়ে পরিবর্তন করে নিতো। উল্লেখ্য, সে সময়ে ইতালীতে বাংলাদেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স পরিবর্তন করে দেয়ার আইন ছিলো। যা পরে বাতিল করা হয়েছে। আইন কানুন না জেনে গাড়ি চালাতে গিয়ে প্রায়ই দূর্ঘটনার মুখে পড়তো বাংলাদেশিরা। বিষয়টি বাবলুকে প্রভাবিত করে। তিনি বাংলা ভাষায় ইতালীয়ান ড্রাইভিং বই লিখার কাজ শুরু করেন। শুরুতে বিষয়টিকে যতোটা সহজ ভেবেছিলেন কাজ করতে গিয়ে দেখেন অনেক কঠিন। তখন তিনি আবার গোড়া থেকে ইতালীয় ড্রাইভিং আইন এবং সড়ক আইনের উপর পড়াশুনা শুরু করেন। টানা একবছর পড়াশুনা করে আবার ফিরে আসেন লিখার টেবিলে। দীর্ঘ সাধনা করে অবশেষে তিনি লিখে ফেলেন ইতালীয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স এবি নামের একটি বই।
বই লিখার কাজ শেষ হলেও সামনে এসে দাড়ায় আরেক নতুন সমস্যা। কোনো ভাবেই প্রকাশক যোগাড় করতে পারছিলেন না তিনি। নিজের টাকা দিয়ে ছাপানো মতো আর্থিক অবস্থাও ছিলো না তার। তিনি হাল ছাড়েন নি। লেগে থেকেছেন। প্রকাশকদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করেছেন। কোনো ভাবেই যখন বাবলু কিছু করতে পারছিলেন না তখন তার কয়েক জন ইতালীয়ান বন্ধু তার পাশে এসে দাড়ায়। তারা বাবলু এবং তার লিখা পান্ডুলিপি নিয়ে একটি প্রেস কনফারেন্স করে। তারা ওই বইয়ের গুরুত্ব এবং আবেদন তুলে ধরে প্রেসের সামনে। এরপর বাবলুকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ইতালীর অন্যতম প্রধান প্রকাশনা সংস্থা ‘আতেছিয়া’ এগিয়ে আসে বইটি ছাপাতে। তারা লেখক বাবলুর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে। শুরু হয় পুরোদমে বই প্রকাশের কাজ। সেখানেও বাবলুর জন্য অপেক্ষা করছিলো বিপত্তি। তখন ইতালীতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে কমপিউটর জানা মানুষের সংখ্যা ছিলো হাতে গোনা কয়েক জন। তাদের দিয়ে ওই বইয়ের কাজ সম্ভব হচ্ছিলো না। প্রকাশকের পরামর্শে বাধ্য হয়ে বাবলু তার পান্ডলিপি ঢাকায় পাঠান কম্পোজ, প্রুফ এবং মেকআপের জন্য। প্রথমে তিনি তার এক সেলিব্রেটি বন্ধুর কাছে পান্ডুলিপিটা পাঠান। অনেক সময় নিয়েও তিনি প্রকাশকের চাহিদা মতো কাজটি করে দিতে পারছিলেন না। বাবলু বাধ্য হন সেখান থেকে পান্ডলিপি ফেরত আনতে। এবার তিনি যার দ্বারস্থ হন তিনি আর কেউ না, লিখনীর সম্পাদক শাহ্ ইফতেখার তারিক। মজার বেপার হলো শাহ্ ইফতেখার তারিক যে শুধু একজন সম্পাদকই নন, একজন ভালো চারু (গ্রাফিক) শিল্পীও তা আমি জেনেছি ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হয়ে এই বইটি পড়ার পর।
লেখক বাবলুর এই চরম কষ্টের ফল ছুয়ে যায় ইতালীতে প্রবাসী সকল বাংলাদেশিদের। মানুষ এই বই পড়ে মনে সাহস পায়। ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি হয়, পরীক্ষা দেয়। পাশ করে গাড়ী চালায়।
জীবন হয়ে উঠে আরো গতিশীল। আমি মনে করি এই গতির পেছনে সব টুকু সফলতা লেখক বাবলুর। তিনি যদি সেদিন কষ্ট করে ওই কাজটি না করতেন, তবে আজ আমরা বাংলাদেশিরা ইতালীতে আরো বেশি পিছিয়ে থাকতাম। বাবলুর ইতালীয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স এবি বইটার প্রথম সংস্করণ আমাদের কমিউনিটিতে মুড়ির মতো বিক্রী হয়েছে। এখন বাজারে রয়েছে এর দ্বিতীয় সংস্করণ। তাও প্রায় শেষ হওয়ার পথে। তবে একটা খবর জেনে বেশ মন খারাপ হয়েছে, আমরা বাংলাদেশিরা কেমন যেনো! রোম এবং মিলানোর কিছু কিছু ব্যবসায়ী এখন বেশি লাভের আশায় বইটি নকল করার চেষ্টা করছে। একমনকি একজন কথিত লেখক এটাকে নকল করে নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন বলেও শুনেছি।
সঠিক কারন আমি জানি না, কেনো শেখ মহিতুর রহমান বাবলু আজ ইতালিতে নেই। কেন তিনি চলেগেছেন ইংল্যান্ডে? এর কোনো উত্তর আমার জানা নেই। শুধু এটুকুই বলতে পারি, তাকে ধরে রাখার মতো সামর্থ হয়তো আমাদের ছিলো না অথবা তার থাকার মতো আনুকুল্য আমরা দিতে পারিনি।
যদ্দুর জানি লন্ডন থেকে সম্প্রচারিত চ্যানেল আই’তে তিনি ইভেন্ট ম্যানেজার হিসাবে জয়েন্ট করেছেন। ওখানের একটি বাংলা কাগজে নিয়োমিত কলাম লিখছেন এবং চ্যানেল আইতে ব্যালান্স ফুড এন্ড হেল্থ বিষয়ক একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন। বিভিন্ন চ্যানেল গুলোর টকশোতে আলোচক হিসাবে উপস্থিত থাকেন।
শেখ মহিতুর রহমান বাবলু ইতালীতে না থাকলেও তার সৃষ্টি আমাদের মাঝে রয়ে গেছে। তার কষ্টের ফল ভোগ করছে গোটা কমিউনিটি। আগামীতেও করবে। এখনো ইতালীর পাঠকরা স্বদেশ বিদেশের পাতায় ‘খেয়াঘাট’ কলামটা খোঁজে। জনপ্রিয় ওই কলামটি লিখতেন বাবলু। তাকে পাঠকরা খুজবে আরো অনেক দিন। হয়তে এক সময় এই খোজাখুজি বন্ধ হবে। কিন্তু বাবলু কখনোই হারিয়ে যাবেন না। তখন তাকে খোজা হবে অন্য আঙ্গিকে। আমাদের কমিউনিটির যেসব ছেলে মেয়েরা এখন ইতালীর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে তারা এক সময় বড় হবে। এদের কেউ কেউ কমিউনিটির অতীত নিয়ে গবেষনা করবে। তখন আবার সামনে চলে আসবে বাবলুদের নাম। যাদের অবদানে আজ ইতালীর বাংলাদেশি কমিউনিটির অবস্থান অনেক উর্ধে। তার এবং তাদের নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে।
তাহমিনা ইয়াসমিন শশী, ভেনিস ইতালী