শেখ মহিতুর রহমান বাবলু :: তখন সেপ্টেম্বর মাসের শেষ ।সারা ইউরোপের প্রকৃতিতে ফুটে আছে গ্রীষ্মের আমেজ। শীতের আগমনী বার্তা আছে কিন্তু শীতের দেখা নেই।একটা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশনে যোগ দিতে কয়েকদিন আগে জার্মানী এসেছিলাম।এখন বাড়ি ফেরার পথে ।
গভীর রাত। ফ্রাঙ্কফুট বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছি। কথা বলছি তথ্য কেন্দ্রের কর্মকর্তার সাথে । আমার ফ্লাইট ভোরে। ব্রিটিশ এয়ারে সন্ধ্যাবেলা ফ্লাইট ছিল। ফ্লাইট মিস করেছি। নতুন করে আবার সেই ব্রিটিশ এয়ারে টিকেট কেটে বসে আছি। কখন ভোরের আলো ফুটবে। আর তখন মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়াল দেব সাগর পাড়ের লন্ডনে ।
তথ্য কেন্দ্রের কর্মকর্তা বেশ আলাপী, অতিশয় ভদ্রলোক ।গভীর রাত তাই তার হাতেও অঢেল সময়। আমাকেও পার করতে হচ্ছে আস্ত একটা বিনিদ্র রজনী । আমি জার্মান ভাষা জানি দেখে ভদ্রলোক ভীষণ খুশি। ব্রেক্সিট নিয়ে কথা বলছি দুজনে ।
একটা মেয়ে ছুটে এলো।অল্প বয়সী মেয়ে। দেখতে বেশ সুন্দর।হালকা পাতলা গড়ন। ভিয়েতনাম ,চিনা বা এ অঞ্চলের হবে। তার হাতে খোলা একটা নতুন মডেলের আপেল ম্যাকবুক এয়ার । জিজ্ঞাসা করলো তথ্য কেন্দ্রের কর্ম কর্তার কাছে।
-পুলিশ স্টেশন কোথায় ?
-পুলিশ স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে।
-আমার ভীষণ প্রয়োজন পুলিশের।
– আমি কি আপনাকে কোনো হেল্প করতে পারি।
-না আমার পুলিশ দরকার।
এবার অনেক বিনয়ের সাথে তথ্য কেন্দ্রের কর্ম কর্তা বললেন
-আমি কি আপনার সমস্যা জানতে পারি মেম ?
-আমার মোবাইল ছিনতাই হয়েছে। ছিনতাইকারী এয়ারপোর্ট এলাকাতেই আছে। এই দেখুন আমার ম্যাকবুকে ছিনতাইকারী অবস্থান ইন্ডিগেট করছে ।
তথ্য কেন্দ্রের কর্ম কর্তা ম্যাকবুকের দিকে না তাকিয়ে মেয়েটির কথা শেষ হবার আগেই নিরাপত্তা কর্মী কল করলেন। মুহূর্তের মধ্যে বিদ্যুতের মতো সাইকেল নিয়ে ছুটে এলো এক নিরাপত্তা কর্মী। সাইকেল মাটিতে ফেলে কোমর থেকে ওয়াকি টোকি হাতে নিয়ে মেয়েটির কাছে দৌড়ে এসে জানতে চাইলো কি হয়েছে। হড় হড় করে সবঘটনার বিবরণ দিলো মেয়েটি ,দেখালো ম্যাকবুকের ইন্ডিকেশন। কথা শুনতে শুনতেই নিরাপত্তা কর্মী ওয়াকি টোকিতে সাংকেতিক ভাষায় কথা বলা শুরু করলো। তার চোখ ম্যাকবুকের দিকে।ম্যাকবুকে গোটা এয়ারপোর্টের ম্যাপ। তার ভিতর একটা সবুজ বাতি নড়া চড়া করছে। বডি ল্যাঙ্গুয়েজে দেখে মনে হলো ম্যাকবুক দেখে ছিতাইকারীর অবস্থান পরিস্কার করছে নিরাপত্তাকর্মী । এদিকে মেয়েটি থর থর করে কাপছে। দুচোখ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে গঙ্গা যমুনা।কপালে তার বিন্দু বিন্দু জ্বল ,মুক্ত দানার মতো ঝিলিক মারছে।
এক দেড় মিনিটের মাথায় নিরাপত্তা কর্মী মেয়েটিকে উদেশ্য করে বললেন “কাঁদবেন না মেম। অপরাধি এখন পুলিশের জালে। আমাদের টহল পুলিশ তাকে ঘিরে ফেলেছে। পালাবার আর কোনো পথ নেই। অপরাধীর ড্রেস, গায়ের রং ,উচ্চতা, হেয়ার স্টাইল ,কোন মহাদেশের মানুষ কিছুই কি মনে আছে” ?
– “না সে আমার পিছন থেকে মোবাইল থাবা দিয়ে কেড়ে নিয়ে পালিয়ে গেছে”।
-“নো অরিজ।পুলিশ উইল ক্যাপচার হিম ভেরি সুন”।
কথাগুলো শুনে মেয়েটি স্বস্তির নিঃশাস ফেললো। তথ্য কেন্দ্রের কর্ম কর্তা তাকে টিসু দিলেন , চোখ মুখ মুছতে বললেন।
-“ক্যাপচার্ড ক্যাপচার্ড”।উল্লাসিত কণ্ঠে নিরাপত্তা কর্মী ।
মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরো বললেন।
– “দুঃখিত মেম। সাধারণ মানুষকে হয়রানি না করার জন্য অপরাধীকে ধরতে কয়েক মিনিট বিলম্ব হলো। পুলিশ তাকে নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের সামনে হাজির হবে ।এই দেখুন ম্যাকবুকের সবুজ বাতিটি দ্রুত আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে”।
ফ্রাঙ্কফুট এয়ারপোর্ট জার্মানির সবচাইতে বড় এয়ারপোর্ট।যার এমাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত হেটে পারহতে সময় লাগে বেশ। এয়ারপোর্টের দুই পাশ দিয়ে সবসময় চলছে ফ্রি সাটেল বাস ও ট্রেন। বাসে চেপে একবার এয়ারপোর্ট ঘুরে আসতে সময় লাগে আট মিনিট ,ট্রেনে লাগে ছয় মিনিট।
কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ বেষ্টিত ছিনতাইকারী এসে হাজির। তার হাতে পায়ে কোথাও হাতকড়া বা বেড়ি নেই। ছিনতাইকারী পকেট থেকে মোবাইল বের করে ভদ্রলোকের মতো তুলে দিলো মেয়েটির হাতে। মেয়েটি ধন্যবাদ জানালো ছিনতাইকারীকে।
মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে পুলিশ বললো, “দেখে নিন সব ঠিক আছে তো “?
-“মোবাইলের সিম নেই। আর সব ঠিক আছে মনে হচ্ছে। ধন্যবাদ”।
-“দুঃখিত মেম আপনার নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করতে বার্থ হয়েছি । তবে লজেস্টিক সাপোর্ট দিয়ে আপনি আমাদেরকে হেল্প করার জন্য অনেক ধন্যবাদ। এই সাপোর্ট না পেলে ছিনতাইকারী ধরতে আরো সময় লাগতে পারতো”।
-“ধন্যবাদ জার্মান পুলিশ প্রশাসনকে”।
একটি দেশের সর্বপ্রকার উন্নয়ন ও অগ্রগতির পূর্বশর্ত হলো শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা। শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ক্ষেত্রে পুলিশের ওপর সমাজ নির্ভরশীল। বিশেষ করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য পুলিশবাহিনীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। পুলিশের ওপর পশ্চিমা সাধারণ নাগরিকরা যেমন ভরসা করেন তেমনি পুলিশকে ভয় পান ঈশ্বরের চাইতেও বেশি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পুলিশের সততা ও দক্ষতার অনেক গল্প আছে আমার ঝুলিতে। তবে এক্ষেত্রে জার্মান পুলিশের তুলনা মেলা ভার।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রায় ২৫ বছর থেকে অবশেষে গ্রেইট বৃটেনে এসেছি। এদেশের পুলিশকে অনেক অসাধ্য সাধন করতে দেখেছি।কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় তাদেরকে ক্ষেত্র বিশেষে জনবান্ধব হতে দেখিনি। একটা গল্প বলি।
বাসের অপেক্ষায় লন্ডনের অলগেট বাস স্টপে দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ একটা মেয়ে চিৎকার করে হাউ মাও করে কেঁদে দিলো। সবার চোখ ঠিখরে পড়লো মেয়েটির দিকে। দেখলাম পাশদিয়ে হেলমেট পড়া দুজন আরোহী বসা একটা মোটরবাইক দ্রুত পালিয়ে গেল। ধারণা করলাম মেয়েটি রাস্তার কিণারাতে দাঁড়িয়ে মোবাইল টিপাটিপি করছিলো। এই সুযোগে ছিনতাইকারী তার মোবাইল কেড়ে নিয়ে পালালো।মেয়েটির পাশে গিয়ে কোনো হেল্প করতে পারি কিনা জানতে চাইলাম। আমার মোবাইলে পুলিশ কল করে তাকে ধরিয়ে দিলাম।পুলিশের সাথে কথা বললো সে।
বিলেতের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল এলাকা সি সি ক্যামেরা দিয়ে ঠাসা। অপরাধী পালাবার যো নেই।সুতরাং পুলিশ চাইলে অনেক কিছু করতে পারে।
ঘটনাস্থলে পুলিশকে আসার জন্য অনুরোধ করলো মেয়েটি।আমরা অপেক্ষা করছি। অবশেষে পুলিশ এলো ঠিকই কিন্তু কিন্তু দুই ঘন্টা পর। বেক্তিগত ব্যস্ততা থাকায় আমার ভিজিটিং কার্ড মেয়েটিকে দিয়ে বললাম কি হলো আমাকে জানাবে পত্রিকায় নিউজ করবো। অনেক দিন পর মেয়েটির সাথে কথা হয়েছিল ,তখনো তার মোবাইলের সন্ধান মেলেনি।
এধরণের ঘটনা একাধিক দেখেছি এবং শুনেছি এদেশে এসে । আমিও এর চাইতে বড় ঘটনার শিকার। কিন্তু ফলাফল শুন্য। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে ছাড়া এমন ঘটনার ছড়াছড়ি পশ্চিমা বিশ্বে আর কোথাও খুব একটা দেখা যায় না।
‘ বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ ঘা’- পুলিশ সম্পর্কে এই আপ্তবাক্যটি বাংলাদেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়।বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি মানুষের আস্থার জায়গাটি কেবলই প্রশ্নবিদ্ধ তা কিন্তু নয় । নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতের ভ্যানিটি ব্যাগ চুরি হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তস্কর পাকড়াও করে পুলিশ প্রমাণ করেছে তারা চাইলে ব্যবস্থা নিতে পারে।কিন্তু পেশাদারিত্বের কথা ভুলে গিয়ে অনিয়ম ও অবৈধ কারবারের সমান্তরালে চলে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার। অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অর্থোপার্জনের অপতৎপরতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সুনাম আজ মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে । । ভীতি প্রদর্শন করে অর্থ আদায় , ভুতুড়ে মামলা হামলা , গ্রেফতার বাণিজ্য ,তল্লাশি নামের তান্ডব ,দলবাজি , চাঁদাবাজির সংস্কৃতি ইত্যাদির কারণে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সম্পর্কে জনমতে বিরাজ করছে আতংক আর ঘৃণা ।বর্তমান বাংলাদেশে প্রজাতন্ত্রের সবচাইতে নিকৃষ্ঠ ও সমালোচিত সংস্থার নাম আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগ।
আমি দুটো সোনার আংটি ব্যবহার করি। ইতালি থেকে কিনেছিলাম। চলতি বছরের গোড়ার দিকে দেশে গেলে আংটি পরে বাইরে যেতে সবাই নিষেধ করেছিল।দেশের বাইরে থাকি একথাও বলতে মানা । কারণ পুলিশ এগুলো দেখলে তল্লাশির নামে ভ্যানের আড়ালে নিয়ে আংটি খুলে নেবে।আর প্রবাসী শুনলে তো কথাই নেই। অজ্ঞাতনামা মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নেবে লাখ লাখ টাকা ।লটারী জেতা আর প্রবাসী ও ভিন্ন মতের মানুষ বাগে পাওয়া পুলিশের কাছে এখন সমান কথা।
দেখলাম দেশের মানুষ নিতান্ত প্রয়োজন না থাকলে সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে যেতে চায় না । কারণ রাত্রিকালীন পুলিশের তল্লাশি নামের তান্ডব দেশের জনগণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। । সাদা পোশাকে কর্তব্য পালনের সময় পুলিশের দাম্ভিক উক্তি ভাষায় প্রকাশ করার নয়। ওদের আচরণ ও তান্ডব দেখলে মনে হয় আসলেই ওরা দেশের রাজা।পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সাদা পোশাকে পুলিশের এই স্পর্ধা দেখার কেউ নেই। কারণ জানতে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সৎ পুলিশের সাথে কথা বলেছিলাম । তিনি যে তথ্য দিলেন তাতে রিতিমত পিলে চমকে যাবার কথা ।
“বর্তমানে পুলিশে চাকরি করতে হলে অবৈধ ভাবে অর্থ উপার্জনের কোনো বিকল্প নেই। সরকারী যেকোনো চাকরীর মতো পুলিশে চাকরি পেতে হলে গুনতে হয় কাড়ি কাড়ি টাকা।ধার দেনা করে চড়া সুদে সবাই এই টাকা যোগাড় করে।এছাড়া ভালো থানায় ট্রান্সফার,পদোন্নতি সহ সবক্ষেত্রই গুনতে হয় টাকা আর টাকা। সবচাইতে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো প্রত্যেকটা থানার উপর রয়েছে সাপ্তাহিক টার্গেট। সপ্তাহ শেষে একটা নিদৃষ্ট পরিমান টাকা দিতে হয় নিকটতম বড়ো থানাকে। এই টার্গেট পূরণে ব্যার্থ হলে নিকটতম বড় থানা থেকেই নেয়া হয় নানা রকম অ্যাকশন। শুনতে হয় অশ্লীল ভাষায় গালাগালি আরো কত কি ।ট্রান্সফার সহ চাকরি হারাবার ভয়ও থাকে তখন। সারা বাংলাদেশ থেকে এভাবে সংগ্রহ করা চাঁদা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে পৌঁছায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত।
লেখক : সাংবাদিক ,কলামিস্ট ,লেখক ( Editor :Newslife24.com)
Published 26 October 2018 Newslife24.com