। শেখ মহিতুর রহমান বাবলু ।।
বহিরাগত ছাত্রদের জন্য পর্তুগালে টিউশন ফি বেশ লোভনীয়। শিক্ষা ভিসা পাওয়া যায় তুলনামূলক সহজে উপায়ে । শিক্ষাবৃত্তি নিয়েও সেদেশে পড়াশুনা করছে অনেক বাংলাদেশী। তাছাড়া স্থায়ী ভাবে থাকা ও অল্প সময়ের মধ্যে নাগরিকত্ব লাভের সুযোগ ইউরোপের যে কোনো দেশের তুলনায় পর্তুগালে অনেক বেশী।
২০০৯ সালের দিকে ব্রিটেনে বহিরাগত ছাত্রদের উপরে নানা শর্ত আরোপ করে হোম অফিস । এর পর থেকে তৃতীয় বিশ্বের অনেক ছাত্রদের এদেশে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। উপায় না দেখে সেসময় অনেকে চলে যায় পর্তুগাল সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে । তাদের অনেকে পর্তুগালের নাগরিকত্ব নিয়ে ফিরে এসেছে ব্রিটেনে। এদের অনেকে আজ ওয়েল স্টাবলিস্ট। অনেকে আবার সুইজারল্যান্ড, জার্মান,ফ্রান্স, বেলজিয়াম, হল্যান্ড, নরওয়ে,ফিনল্যাণ্ড ইত্যাদি দেশ গুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে।
পর্তুগালের অভিবাসন ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র দেখে কিছু একটা লেখার ইচ্ছা অনেক দিনের। অবশেষে গত ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেই সম্ভাবনাময় এই দেশটিতে যাবার। যাবার আগে যোগাযোগ করি সেদেশের কাউন্সিলর রানা তাসলিম উদ্দীন, অভিভাষণ সংক্রান্ত সরকারি কর্মকর্তা মঈন উদ্দীন আহমেদ ও জিএস পর্তুগাল মাল্টিকালচারাল একাডেমি’র সাধারণসম্পাদক রাসেল আহমেদ সহ অনেকের সাথে। আমার ভ্রমণ সঙ্গী হিসাবে ফারিয়া, শুভ ও আদনানের যাবার কথা ছিল। বিমান টিকেট হোটেল বুকিং সবকিছুই শেষ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভিসা জটিলতার কারণে আদনানের আর যাওয়া হলো না।
লিসবোনকে পর্তুগিজ ভাষায় লিসবুয়া বলে। ফারিয়া, শুভ ও আমি লিসবন বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দেখি মঈন দাঁড়িয়ে আছে।স্বাগত জানানোর জন্য। আমাদেরকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে মঈন চলে গেলো। পরদিন অফিসে তার সাথে দুপুরের খাবার খেতে অনুরোধ জানালো আমাকে।
ইতিমধ্যে নাজমুল এসে গেছে।ছয় বছর আগে লন্ডন থেকে লিসবন এসেছে ইউরোপিয়ান নাগরিকত্ব পাবার আসায়।ইতিমধ্যে তা পেয়েও গেছে। স্বপরিবারে আবার লন্ডনে মুভ করার পরিকল্পনা করছে সে । শুভর ছোট বেলার বন্ধু নাজমুল । দীর্ঘ ১৮ বছর পর তাদের দেখা। আবেগে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলো একে অপরকে। পুরানো দিনের স্মৃতি চারণ করলো ওরা। কখনো নিজেদের নিয়ে কখনো অন্যদের নিয়ে কথা বলতে বলতে পেরিয়ে গেলো অনেক সময়। সে এক অপূর্ব দৃশ্য।
আমরা যে’কদিন পর্তুগাল ছিলাম নাজমুল প্রায় সবসময় শুভ ও ফারিয়ার সাথে সঙ্গ দিয়েছিলো। পেশাগত কাজে আমি ছুটে বেড়িয়েছি লিসবনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে । ভ্রমণে বাঁধ সাধতে চাইনি। তাই ওদেরকে অনেক দর্শনীয় স্থান ঘুরতে হয়েছে আমাকে ছাড়া। তবে নাজমুলের আন্তরিক আতিথিয়তা ও তার গিন্নী বন্যা ভাবীর সুস্বাদু শাহী খানাপিনার কথা কোনো ভাবেই ভুলে যাবার না।
ভ্রমণ হচ্ছে সাধারণ জ্ঞান আহরণের সবচাইতে বড় মাধ্যম । জীবনের অনেক কঠিন অংক খুব সহজেই মিলে যেতে পারে মনের মত ভ্রমণ সঙ্গী থাকলে। ভ্ৰমণের স্বাধ নিতে পারলে । আমি বরাবরই ভ্রমণ প্রিয় মানুষ। তাই কোথাও বেড়াতে গেলে সে জায়গা সম্পর্কে আগাম লেখাপড়া করে যাই। এটা আমার পুরানো অভ্যাস। এই প্রথম দেখলাম ফারিয়া এ ব্যাপারে আমার চাইতে এক ধাপ এগিয়ে। সেও পর্তুগাল সম্পর্কে স্টাডি করেছে বেশ।
নাজমুল আমাদের প্রথমে নিয়ে গেল লিসবনের ট্রাডিশনাল থিফ মার্কেটে। এটা একটা খোলা হাট । সপ্তাহে দুদিন বসে খোলা আকাশের নিচে । মঙ্গলবার আর শনিবার। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। পর্তুগিজ ভাষায় এটাকে বলা হয় “ফিয়েরা দা লাদরা” বাংলায় অনুবাদ করলে বলা যাবে “মহিলা চোরদের বাজার”।
ঐতিহাসিকদেরমতে এই বাজার বহু পুরানো। ১২ খ্রিস্টাব্দে এটার সূচনা। তবে “ফিয়েরা দা লাদরা” নামকরণ হয় ১৭ খ্রিস্টাব্দে।
কতিথ আছে যে বছরের শেষ রাতে অন্তত কিছু একটা চুরি করতে না পারলে, সারা বছর রোজগারপাতি খারাপ যাবে— মহিলা চোরেদের জগতে এমন একটি প্রবাদ সেসময় খুবই চালু ছিল ।৩১ ডিসেম্বর রাত ছিল লিসবনের সব ধরনের চোরেদের হালখাতা করার রাত। মানে এই রাতটিতে কোথাও না কোথাও চুরি করে চোরেরা তাদের নতুন ‘চৌর্যাব্দ’ শুরু করতো ।
ডিসেম্বর জুড়ে সন্ধে থেকেই হরেক রকমের বাতির আলোয় ভেসে যায় লিসবন । সুতরাং সেই আলো আর জেগে থাকা অত মানুষের চোখ এড়িয়ে যে-চোর কোনও গেরস্তবাড়ি থেকে কিছু চুরি করে আনতে পারে, বোঝা যায়, সত্যিই সে ভাল বংশের চোর । আর এই ধারণাটি থেকেই সম্ভবত এই রাতে কিছু না কিছু চুরি করে মহিলা চোরেরা নতুন বছরের কর্মজীবন শুরু করতো ।পরে বিক্রির জন্য নিয়ে আসতো এই খোলা বাজারে।কালের পরিক্রমায় এটা আজ পরিণত হয়েছে সাপ্তাহিক পুরানো জিনিসের খোলা হাটে।
ফারিয়ার খুব আগ্রহ এই হাট দেখার। লিসবনে আসার আগেই সে টার্গেট করেছে। শুভ ও ফারিহা ঘুরে ঘুরে দেখছে। পছন্দের জিনিসের দাম জিজ্ঞাসা করছে।কিন্তু কিনছে না।
হোক না যতই বিশ্বায়ন, খোলা বাজার, সুপার মার্কেট, অনলাইন শপিং, ব্রেন্ডেড জিনিসের দিন। তবুও ইউরোপিয়ানদের স্থানীয় ছোট ছোট পুরাতন জিনিসের প্রতি খুব আকর্ষণ। পুরানো বইয়ের সোঁদা গন্ধে, কিংবা কোন এক পুরানো ছবির রঙের পোঁচে ডুবে যেতে ইউরোপিয়ানদের মনে হয় খুব ভালো লাগে। এখানে মানুষের কাছে যেন অঢেল সময়। লন্ডনের মতো সময়ের আগে আগে অহেতুক দৌড়নোর চেষ্টা দেখি না। এক ধীর স্থির শান্তি বিরাজমান এই শহরের প্রানে, ছন্দে।
শনিবার এখানে বাচ্চাদের ও চাকরিজীবীদের ছুটি থাকে। শুধু লিসবনে না গোটা ইউরোপ জুড়ে শনিবার বা রোববার জায়গায় জায়গায় সারাদিনের হাট বসে। দিনটা যদি রৌদ্রদীপ্ত উজ্জ্বল হয়, ইউরোপিয়ান হাটের এই শান্ত বেচা কেনা, লেনদেন এক সুন্দর নিশিন্তির ছবি তুলে ধরে।
লিসবনের প্রধান কেন্দ্র যাকে ঘিরে লিসবনের সব কিছু – সেই চত্বরে নানান জিনিসের এই হাট লিসবনে আগত অনেক ভ্রমণকারীর এক আকর্ষণ। অনেকেই এই হাটের নানা চেনা অচেনা জিনিস দেখে বেড়ায়, জানি না কতটা সেই জিনিসের দরকার বা কতটা কেনে। আফ্রিকান মুখোশ, ছবি থেকে শুরু করে মরোক্কান নক্সা কাঁটা মাটির বাসন, ভারতবর্ষের শাড়ি, টুপি, ব্যাগ, জুতো,ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী সবই দেখি নিজের জায়গা করে নিয়েছে এই হাটে।
জিনিস দেখতে দেখতে অনেকেই অনেক অহেতুক জিনিস কিনে ঘরে ফেরে। কেনা কাটি বোধহয় মানুষের এক মৌলিক প্রবৃত্তি। প্রাণচঞ্চল হাটে কেনা কাটি করলে মন বেশ ভালো হয় । অধিকারবোধের এক আত্ম সন্তুষ্টি হয়। আর সেই কারনেই বোধহয় ইউরোপে উদার আকাশের নীচে হাট সংস্কৃতি এখনো বজায় আছে।
লিসবনের বয়স প্রায় ৩৩০০ বছর। বলা হয় এথেন্সের পরে লিসবন ইউরোপের দ্বিতীয় প্রাচীনতম রাজধানী। ফলে এর ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। দেখার মত অনেক কিছুই আছে এ শহরে।আমরা মাত্র ২/৩ দিনের জন্য এখানে এসেছি। এতো অল্প সময়ে তেমন কিছু দেখা যাবে না। আমার একটু বেশি সময় থাকার ইচ্ছা থাকলেও ফারিহা থাকতে পারছে না। অফিস কামাই দিয়ে ভ্রমণ করতে সে নারাজ ।
এবার আমাদের গন্তব্য “মনুমেন্ট অফ দি ডিসকভারিজ”। এটি একটি স্মৃতিস্তম্ভ। পর্তুগিজ ভাষায় যাকে বলে “পদরাও দোছ ডিস্কোবরীমেনতো ইন পর্তুগেছে” ।এটা গোটা পর্তুগালের একটা বিখ্যাত পর্যটন এলাকা।বলা হয় এখান থেকেই পর্তুগিজ নাবিক ও আবিষ্কারক ভাসকো দা গামার জাহাজ ছেড়ে ছিল আফ্রিকা ও এশিয়ার উদ্দেশ্যে। ইতিহাসে যা “পর্তুগীজ এইজ অফ ডিসকভারি” নামে পরিচিত। সেই স্মৃতি সামনে রেখেই মনুমেন্ট অফ দ্য ডিস্কভারিস তৈরি করা হয়।
যাবার পথে অন্য একটা মনুমেন্ট চোখে পড়ল। একটু অন্যরকম।মনুমেন্টের গায়ে সব পর্তুগীজ ভাষায় লেখা। তাই বুঝতে পারলাম না।পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ইতিহাস নিন্দিত যুগযুগ ধরে পশ্চিমাদের মাঝে ধর্মের নামে লোমহর্ষক বর্বরতার কাহিনী ।যে কাহিনীর শিকার কিছু নির্যাতিত নিপীড়িত ইহুদীদের স্মৃতি স্বরূপ এই মনুমেন্ট আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে
ওটা তৈরি করা হয়েছে যে ঘটনার স্মৃতিতে ইতিহাসের পাতায় তা “দি লিসবন ম্যাসাকার” নামে পরিচিত। ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দ। ক্যাথলিক মোনার্কেরা স্পেনের কাস্তিয়ে এবং আরাগণ থেকে ইহুদীদেরকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় । প্রায় ৯৩,০০০ হাজার ইহুদী শরণার্থী পর্তুগাল আশ্রয় গ্রহণ করে। তবে স্পেনের চাপের মুখে বাধ্য হয়ে পর্তূগালের রাজা মানুয়েল-১ ১৪৯৭ সালে সব শরনার্থীকে ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করেন। এ ঘটনার ৯ বছর পরে ১৫০৬ সালের ১৯শে এপ্রিল বিকেলে ধর্মবিশ্বাসী ক্যাথলিকেরা সাও ডমিংগোস দি লিসবোয়া কনভেঞ্ছিতে প্রার্থনা করছিল। এর মধ্যে হঠাৎ একজন বলে উঠে সে অল্টারে যিশুখৃষ্টকে দেখতে পেয়েছে। একজন ধর্মান্তরিত ইহুদী বলে বসে ওটা বোধহয় মোমের আলোয় দৃষ্টিভ্রম।
আর যাবে কোথায়। তাকে চুল ধরে টেনে হেঁচড়ে বাইরে নিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। এরপরে তার লাশ রসসিও স্কয়ারে নিয়ে আগুনে পোড়ানো হয়। ক্রুদ্ধ জনতা এখানেই শান্ত হয় না। তাদের তখন রক্তের নেশায় পেয়ে বসছে। আগে থেকেই তারা ধর্মান্তরিত ইহুদীদের বিশ্বাস করত না। এ ঘটনার পরে তারা মেতে উঠে ইহুদী নিধনে। সেদিন প্রায় ২০০০ ইহুদীকে হত্যা করা হয়েছিল ধর্মের নামে। এ ঘটনাই “দি লিসবন ম্যাসাকার” নামে পরিচিত।
আমরা এবার এসে পৌছালাম লিসবন সিটি সেন্টার থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে টাগুস নদী কোলে অবস্থিত “মনুমেন্ট অফ দি ডিসকভারিজ” চত্বরে। এখানে মানুষ আর মানুষ। সবাই ছবি তুলতে ব্যাস্ত।আধুনিক প্রত্নতত্ত্ব ও নয়নাভিরাম সৌন্দর্য মন্ডিত “মনুমেন্ট অফ দি ডিসকভারিজ স্মৃতিস্তম্ভ দর্শনার্থীদের সত্যিই মুগ্ধ করে।স্মৃতিস্তম্ভটির এক পাশে অনেকগুলো মূর্তি। বলা হয় এগুলো ভাসকো দা গামা ও তার ভ্রমণ সঙ্গীদের মূর্তি। ফারিয়া ও শুভ টপাটপ ছবি তুলছে। আমি এই ফাঁকে টিভি রিপোর্টিং এর জন্য কিছু ইন্টারভিউ নিয়ে নিলাম।
তখন ছিল রেনেসাঁর যুগ।১৪৯৭ সালের জুন মাস। ভাসকো দা গামা যাত্রা শুরু করেন আফ্রিকা ও এশিয়ার উদ্দেশ্যে। ১৪৯৮ সালে প্রথম বারের মত দুর্যোগপূর্ণ দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূল পাড়ি দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেসের কেরালার কালীকাটে জাহাজ নোঙর করেন তিনি । তার সে আবিষ্কার পর্তুগিজদের জন্য বিশাল সৌভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছিল।এ ঘটনার পর ইন্ডিয়ান মসলার বাণিজ্য ব্যাপক প্রভাব ফেলতে শুরু করে পর্তুগালের অর্থনীতিতে। নিমিষেই খুলে যায় তৎকালীন অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল একটি জাতির সম্ভাবনার দ্বার। অল্প সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ায় তাদের ভাগ্যের চাকা।
ভাস্কো দ্য গামার ঐ যাত্রাকে স্মরণ করে “মনুমেন্ট অফ দি ডিসকভারিজ” অস্থায়ীভাবে নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৪০ সালে। যেটা ১৯৪৩ সালে ভেঙ্গে ফেলা হয়। এরপর আবার ১৯৬০ সালে স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হয় । যার বেশির ভাগ অর্থের যোগান আসে আমাদের উপমহাদেশের মসলা বাণিজ্য থেকে।( চলবে)
লেখক : Editor : Newslife24.com, কলামিস্ট।
London : December 2019