মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আব্দুল মাবুদ এর আক্ষেপ ও অনুভূতি

1398 Visited

21 Sep
মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আব্দুল মাবুদ এর  আক্ষেপ ও অনুভূতি

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়েছে। বিগত প্রায় অর্ধ শতাব্দীতে  অনেক পরিবর্তন এসেছে। জনসংখ্যা বেড়েছে। গোটা বিশ্বের মতো জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশে ।কিছুটা হলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি মিললেও ভোটাধিকার মেলেনি।মেলেনি বাক স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার।  শিক্ষার হার বেড়েছে। কমেছে  প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ । শিক্ষা ব্যবস্থার অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে ।বৈষম্য বেড়েছে।ধর্মীয় অনুভূতি  ,মূল্যবোধ ও  নীতি নৈতিকতার উন্মেষ  ঘটেনি।অর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে লেগেছে পরিবর্তনের হওয়া।অবৈধ অর্থে সুবিধাবাদীদের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে।


বাংলাদেশ  গণতান্ত্রিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে ।পেয়েছে গৌরবোজ্জ্বল একটি পতাকা। একটি মানচিত্র। কিন্তু যাদের আত্মদান ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা তাদের অনেকে আজও পদদলিত,উপেক্ষিত, অবহেলিত ও নিষ্পেষিত। 

বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। জীবনের মায়া ত্যাগ করে এ দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওরা । নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েছিলেন তাজাপ্রান। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক কিছুই পাবার কথা ছিল। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে বিগত ৪৯ বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা নির্ভুল তালিকা প্রণয়ন করা  সম্ভব হয়নি । ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে  ছেয়ে গেছে দেশ।এমনটি তো হবার কথা ছিল না।এ জন্য কি ওরা  জীবনের মায়া ত্যাগ করে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলো  ?
হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যেসব দামাল ছেলে  তাদেরই একজন মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আব্দুল মাবুদ  ।সাংবাদিক  শেখ মহিতুর রহমান বাবলু তার সাথে দুই ঘন্টা বাইশ মিনিট কথা বলে  লিখেছেন জানা অজানা এই মুক্তিযোদ্ধার আক্ষেপ ও অনুভূতির  কথা  । 

১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রামের  এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন  বীর মুক্তিযোদ্ধা মাবুদ সৈয়দ।বাবা আব্দুস সামাদ সরকারি চাকরিজীবী। মা চেমন আরা বেগম গৃহিনী।পরিবারে ৩ ভাই ৪ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়ো। 
১৯৭১ সালে মাবুদ  ছিলেন সাতকানিয়া সরকারি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক  পরিক্ষাত্রী। রাজনীতিতে  পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ সাতকানিয়া থানার সাধারণ সম্পাদক ও স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মেম্বার সেক্রেটারি  । টগবগে এই যুবক ছোট বেলা থেকেই  ছিলেন সচেতন  রাজনীতিবিদ। 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে মাবুদ বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক। সামরিক শাসন এবং পাকিস্তানী সামরিক জান্তার গণতন্ত্র বিরোধী অপশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনের পর আসে ওই নির্বাচন। সেই নির্বাচনে মাওলানা ভাসানী অংশ নেননি। ফলে  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি তে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮ টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ।

এই  সময় মওলানা ভাসানী নির্বাচন বয়কট করার কারণ হিসাবে তিনি বলেন ।মাওলানা ভাসানী ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টাদের অন্যতম ।প্রচন্ড রাজনৈতিক দূরদর্শিতা সম্পন্ন এই মজলুম নেতা  বুঝতে পেরেছিলেন যে পাকিস্তানিদের সাথে নির্বাচনে গিয়ে লাভ হবে না। তিমি বললেন  "ভোটের বাক্সে লাথি মারো বাংলাদেশ কে স্বাধীন করো"।  ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে  প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের ত্রাণ ও  পুনর্বাসনে ঝাঁপিয়ে পড়েন  ভাসানী । ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি  কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলার কারণে মাওলানা প্রকাশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রশ্নে  বয়কট করেন সত্তুরের নির্বাচন।

এদিকে  তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বাধিক আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো আওয়ামী লীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনে তাঁর সম্মতির কথা ঘোষণা করেন।শুরু হয়  সরকার গঠনের প্রক্রিয়া।  ঢাকায় তদানীন্তন আইয়ুব নগর অর্থাৎ তেজগাঁও  পার্লামেন্ট ভবন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার কাজ শুরু হয় । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কে কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবেন ও  সরকার গঠনের রূপরেখা নিয়ে  চলতে থাকে দফায় দফায় মিটিং সিটিং ।
হঠাৎ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে ১ মার্চ বেলা একটার সময় ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্ট কালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করেন। ৯ মার্চ বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে টিক্কা খানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানান।
১২ মার্চ বাঙালি সিএসপি অফিসাররা অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। তাঁরা আওয়ামী লীগের ত্রাণ তহবিলে একদিনের বেতন দান করার  সিদ্ধান্তের কথা জানান।১৩ মার্চ সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ ১১৫ নং সামরিক আইন আদেশ জারি করে।১৪ মার্চ কর্মচারীরা সামরিক আইন অমান্য করে এর বিরুদ্ধে মিছিল বের করেন।

শুরু হয় তীব্র রাজনৈতিক সংকট।প্রতিবাদের ঝড় ওঠে  সারা বাংলায় ।পাকিস্তানের হীন ষড়যন্ত্রের রোষে ফেটে পড়ে জনতা ও ছাত্র সমাজ। তখন থেকেই ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্র সমাজ ও বাংলার সাধারণ  মানুষ দেশের স্বাধীনতা  যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে । ‘পূর্ব পাকিস্তান’ তখন ‘বাংলাদেশ’। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা দেশ। "তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা " "বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো পাকিস্তানিদের খতম করো"......
১৯৭১ সালের ২ মার্চ আ স ম আব্দুর রব প্রথম বাংলাদেশের  মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন।এর পর থেকে  পতাকায় পতাকায় ছেয়ে যেতে থাকে দেশ। 


 ৩ মার্চ ১৯৭১ পল্টন ময়দানে বিশাল এক ছাত্র জনসভায় বঙ্গবন্ধুর সামনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করলেন  তদানীন্তন  ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক  শাজাহান সিরাজ। এদিকে ৭ মার্চ ঢাকায় স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বললেন "জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে" অন্যথায় এবারের সংগ্রাম  স্বাধীনতার সংগ্রাম..... 

 

অবস্থা বেগতিক দেখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় উড়ে আসেন । ১৬ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া একান্ত বৈঠক হলো । ১৭, ১৯ ও ২০ মার্চ আবারো  দুজনের মধ্যে কথা হয়। তাদের দুজনের সঙ্গে ছিল নিজ নিজ পরামর্শক টিম। তারা জানাল, কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, যার ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট একটা ফরমান জারি করবেন।

এদিকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ২৩ মার্চ উদযাপিত হতো পাকিস্তান দিবস বা লাহোর প্রস্তাব দিবস হিসেবে। এদিন পাকিস্তানের পতাকায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকত রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, দোকানপাট ।কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ  কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের  উদ্যোগে  ক্যান্টনমেন্ট, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের অবাঙালি অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকা ছাড়া সব যায়গায় বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়।

এটি সূর্যের আলোর  মতো সত্য যে শুধু ঢাকা শহর  নয়, সমগ্র দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা ও মহকুমা শহরেও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে একযোগে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে পত পত করে । এমনকি ঢাকার প্রতিটি দূতাবাসেও পাকিস্তানের চাঁদ-তারাওয়ালা পতাকার পরিবর্তে উত্তোলিত হয় বাংলাদেশের পতাকা।
সত্য যে ওই দিন  জুলফিকার আলী ভুট্টো অবস্থান করছিলেন  ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সেখানেও  উত্তোলন করা হয় স্বাধীন  বাংলাদেশের পতাকা। যেদিকে চোখ যায়, শুধু বাংলাদেশের পতাকা আর পতাকা।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ সৈয়দ  মাবুদ ও তার সঙ্গী সাথীরা চট্টগ্রাম সাতকানিয়া থানার পুলিশ মাঠে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে উত্তোলন করেন লাল সবুজের পতাকা।   

 ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর ইয়াহিয়ার সাথে বঙ্গবন্ধুর বার বার বৈঠক করার পিছনে কারণ ছিল তিনি ভেবেছিলেন প্রদেশে ক্ষমতা  লাভ করা গেলে ছাত্র ও জনতার আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়বে এবং সেই অবকাশে অর্জন করা যাবে পাকিস্তান ভিত্তিক সমাধান। কিন্তু একদিকে ক্ষমতা অংশীদারিত্বের প্রশ্নে পাকিস্তানের  অনমনীয়তা এবং অন্যদিকে স্বাধীনতার প্রশ্নে ছাত্র ও সাধারণ মানুষের প্রবল চাপ বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রতিকূল পরিবেশের সৃষ্টি করেছিল। তাই তিনি ২৩ মার্চ ইয়াহিয়ার পরামর্শক দলের সঙ্গে আবার বৈঠক করেন । ওই বৈঠকে দেশের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ হতে হবে বলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া হয়।  এদিকে আলোচনার জন্য  ভুট্টো ঢাকায় চলে  আসেন। ২৪ মার্চ ফের ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা হয়। আলোচনা ব্যর্থ হলে  ২৫ মার্চ  ইয়াহিয়ারা  ঢাকা ত্যাগ করেন ।

২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কিছু এলাকায় জনতার ওপর সেনাবাহিনীর হামলার প্রতিবাদে ২৭ মার্চ হরতাল ডাকেন। এটাই ছিল ২৫ মার্চ কালরাতের আগে আওয়ামী লীগের শেষ কর্মসূচি।২৫ মার্চ দিবাগত রাতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনী চালায় গণহত্যার নিষ্ঠুর অভিযান।বন্ধি করা হয় বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে ।২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার ও পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে চট্টগ্রামে মেজর জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর শপথ ভঙ্গ করে ‘আই রিভোল্ট’ বলে বিদ্রোহের ডাক দেন । ২৭ মার্চ বিকেলে প্রথমে নিজের নামে পরে বঙ্গবন্ধুর নামে মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে রেডিও মারফত স্বাধীনতার ডাক দেন ।

মাবুদ বলেন ,১ মার্চ ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করতেই উত্তাল হয়ে ওঠে দেশ। উত্তেজনায় ভরপুর, চারিদিকে ভয়ংকর পরিস্থিতি । ‘পাকিস্তান’ নাটকের শেষ দৃশ্যটি তখন মঞ্চে উপস্থাপিত হচ্ছে। আমরা সাতকানিয়া গোয়াজর পাড়া প্রাইমারি স্কুলের মাঠে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করি। ইতিপূর্বে অস্ত্রের দোকান ,ব্যাংকের ভোল্ট ও পাঞ্জাবিদের কাছ থেকে অস্ত্র লুট করে এনেছি। ছুটিতে দেশে আসা সুবেদার মেজর মোজাফ্ফর আহমেদ ও হাবিলদার কাদের আমাদের প্রশিক্ষক।

২৫ মার্চ রাতের আঁধারে হানাদার বাহিনী নিরীহ মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লে আমরা প্রশিক্ষণ বন্ধ করে চট্টগ্রাম শহরে চলে যাই। সেখানে আমরা পাকিস্তানিদের সাথে স্ট্রিট ফাইটিং এ জড়িয়ে পড়ি। হামলা চালাই সামরিক জাহাজে । চট্টগ্রাম শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে আমরা আশ্রয় নেই কালুর ঘাট এলাকার পাশে গড়ে ওঠা একটা লিয়াজু সেন্টারে। ওখানে তখন অবস্থান করছিলো রিভোল্ট করা মেজর জিয়া ,মেজর শওকত ,লেফটেনেন্ট শমসের মবিন ,ক্যাপ্টেন হারুন ও অন্যান্য সেনা অফিসার সহ কিছু সৈনিক।এর একদিন পর জুম্মার দিন কালুরঘাট ,পটিয়া ,সাতকানিয়া ও আমিরাবাদে পাকিস্তানি বিমান বাহিনী হামলা চালায়। তখন পটিয়া গার্লস স্কুলে আমাদের ঘাঁটি স্থানান্তর করি।সাথে নিয়ে আসি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিশন যন্ত্র পাতি। এর ২/৩ দিনের মধ্যে মেজর জিয়া ও তার সঙ্গীরা পালিয়ে যান ভারতে।

আমরাও চলে যাই সাতকানিয়া।  এপ্রিল মাসে এস এস সি পরীক্ষা যাতে না হতে পারে এজন্য আমরা পরীক্ষা কেন্দ্রে হামলা চালাই।আধো আধো জ্যোৎস্না প্লাবিত  মায়াবী রাত,পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সাতকানিয়া ডাকবাংলোতে দুই দিক থেকে আক্রমণ করে সব তছনছ করে দিলো । অবস্থা ভয়াবহ হতে পারে ভেবে ভোর হবার আগেই আমরা ওই অঞ্চল ত্যাগ  করি। ততদিনে চট্টগ্রাম থেকে ভারতে যাবার সব সহজ পথ বন্ধ প্রায়। পাকিস্তানিরা যুবক দেখলেই নির্বিচারে অত্যাচার করছে। আমরা ১৪/১৫ জনের একটি দল পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি উঁচু নিচু পথ ধরে ভারতের উদ্দেশে রওনা   দিলাম।সাথে ছিল কিছু শুকনা খাবার। সারাদিন হাটি আর রাতে একটু বিশ্রাম নেই।পথ আর শেষ হয় না। আমরা কোথায় আছি তাও জানিনা ।অজানার উদ্দেশ্যে ছুটে চলা। পাকিস্তানিদের কবল থেকে দেশ স্বাধীন করতেই হবে। ১২/১৩ দিন হাঁটার পর আমরা একটা পাহাড়ে ঘেরা সুন্দর অঞ্চলে গিয়ে পৌছালাম। সেখানে কোনো জনবসতি ছিল না। পরে জানতে পারি ওটা ছিল ভারতের মিজুরাম।

 
শরণার্থী সহ এখানে আমরা প্রায় ২০০ মানুষ একত্রিত হয়েছি।হটাৎ দেখলাম  মাথার উপর দিয়ে হেলিকপ্টার ঘুরাফেরা করছে। সবাই রঙিন কাপড় নেড়ে আমাদের অবস্থান জানানোর চেষ্টা করলাম। এদিকে আমাদের মধ্যে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যে পুকুরের পানি পান করি ওখানেই গোসল ও টয়লেট পরবর্তী পানি ব্যবহার করি।সুতরাং পেটের  পীড়ায়  অনেকেই আক্রান্ত। 

ইতিমধ্যে হেলিকপ্টার থেকে  খাদ্য সরবরাহ শুরু হলো।আমরা আস্বস্থ হলাম । বুঝতে বাকি রইলোনা যে আমরা পাকিস্তান সীমানা অতিক্রম করে ভারতে অবস্থান করছি।এর ২/৩ দিন পর  হেলিকপ্টার যোগে  ভারতীয় সেনা সদস্যরা এসে আমাদেরকে দুই ভাগে বিভক্ত করলো ।শরণার্থীদের নেয়া হলো ভিন্ন কোথাও আর মুক্তিযুদ্ধ উপলক্ষে আগতদের সারাদিন পায়ে হাটা পথ ধরে নেয়া হলো দেমত্রি। সেখানে অন্ন  বস্ত্র ও  চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো ।থাকার জন্য দেয়া হলো তাবু। আমরা পাকিস্তানি গুপ্তচর কিনা তা প্রমাণের জন্য নানা  কৌশলে আমাদেরকে সপ্তাহ ব্যাপী  পরীক্ষা করা হলো ।

অবশেষে আমাদের কে দুই সপ্তাহ রাইফেল ও গ্রেনেট নিক্ষেপ এর  উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে ১৯৭১ সালের মে মাসে ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে পাঠানো হলো দেশের অভ্যন্তরে ।

ভারত সরকার প্রথম দিকে আমাদের কে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করেনি।সুতরাং বার বার আমাদের কে  ফিরে যেতে হয়েছে ভারতে। আগস্ট মাস আসতেই  গোলাবারুদ শেষ। কি দিয়ে যুদ্ধ করবো ?  ফিরে যাই ভারতে। অক্টোবরে চলে আসি রাঙামাটি ও পার্বত্য এলাকায়। সেক্টর -১ এ মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম সেক্টর কমান্ডারের অধীনে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক দুঃসাহসী অভিযানে অংশ নিতে থাকলাম।এসময় বহুবার আমাদের কে জীবন মৃত্যুর সীমারেখায় উপস্থিত হতে হয়েছে। কিন্তু কখনো পিছু হটে আসিনি। বরং আরো তীব্র আক্রোশে এগিয়ে গিয়েছি শত্রু মোকাবেলায় ।যুদ্ধ করতে করতে নভেম্বর মাসে আমরা বান্দরবান এসে পৌঁছাই।

 ১৯৭১ সালের অক্টোবর নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর পরিমাণ বৃদ্ধি হলো ।লড়াই বেগবান হতে থাকলো।কোনঠাসা হয়ে পড়ে হানাদার বাহিনী।ডিসেম্বরে প্রথম দিকে ধোপাছড়ি। একই  মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সাতকানিয়া থানার পুরানগড় বাজারিয়া দখল করি। ১৫ ডিসেম্বর শত্রুদের সাথে আমাদের দোহাজারীতে  প্রচন্ড  লড়াই হয়। 

একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা উত্তাল রণাঙ্গণে বহুবার  পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেই।যে কোনো মুহূর্তে একটা মাত্র বুলেট নিভিয়ে দিতে পারতো আমাদের জীবন প্রদীপ। তবুও পরিমল জীবনের ভয়ে পিছু হটে যাইনি।শত্রু বাহিনী গুলি করতে করতে এগিয়ে এসেছে।এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে আমরা পিছু হটিনি।মাতৃভূমি রক্ষার  তাগিদে আমরা ছিলাম প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।সাহসের সাথে মৃত্যুকে পরোয়া না করে পাকিস্তানের মোকাবেলা করেছি। আমরা সম্মুখ যুদ্ধের চাইতে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করেছি বেশি। আমাদের উপর নির্দেশনা ছিল তেমন।হানাদার বাহিনীকে ভীতির মধ্যে রাখা ছিল আমাদের প্রধান কাজ ।ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানি বাহিনীকে ভীষণ ভয় পেতো। অপারেশন চলাকালীন  আমাদের কে সামনে দিয়ে তারা পিছনে থাকতো।যুদ্ধ চলাকালে মুসলিম লীগ ও রাজাকারদের একাংশ আমাদের কে বিভিন্ন ভাবে গোপনে গোপনে সহযোগিতা করেছে ।

১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আমাদের এলাকায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এভাবে কখন যে পার হয়ে যায় নয় মাস টেরও পাইনি।দেশ স্বাধীন হলো।পরম প্রিয় স্বাধীনতা পেতেই  দুচোখ বেয়ে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সবার।অস্থির হয়ে গেলাম কখন ফিরবো আমার স্বাধীন বাংলাদেশের নিজ এলাকায় ? যে দেশের জন্য রক্ত দিয়েছি জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলাম বিগত প্রায় একটি বছর তিন মাস।অবশেষে ১৭ ডিসেম্বর  এলাকায় ফিরে সাতকানিয়া ডাকবাংলায় ক্যাম্প করি।

দেশের সূর্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আব্দুল মাবুদ বীরের বেশে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যান লেখাপড়া ও রাজনীতিতে। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু  প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশ সেরা  বিদ্যাপীঠে পড়ার সুযোগ পেয়েও এলাকার স্বার্থে চট্টগ্রামের নেতাদের অনুরোধে তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সর্বদলীয় সরকার গঠনের দাবিতে ছাত্রলীগের রাজনীতি বিদ হিসাবে ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে সৈয়দ মাবুদ নিক্ষিপ্ত হন অন্ধকার কারাগারে। ১৯৭৬ সালে সিপাহী বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে আবারো বন্ধি হন। ১৯৭৮ সালে জেল থেকে মুক্তি পান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

১৯৮৩ সালে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় এই নেতা আবারো কারারুদ্ধ হন।

 রাজনীতির মাঠে ক্লান্ত মুক্তিযোদ্ধা মাবুদ ১৯৮৪ সালে  চট্টগ্রামের লোহাগাড়া জনকল্যাণ কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। সেখানে তার মন বসে নি। ১৯৮৫ সালে চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়।

 ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের যুব কল্যাণ কেন্দ্র তে  চুক্তিভিত্তিক এডিশনাল সেক্রেটারি সমমর্যাদায় চাকরি করেন। 

১৯৮৯ সালে সৈয়দ মাবুদ লুৎফুন নেছা  সিদ্দিকা পলি'র সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন।  ১৯৯৩ সালে পাড়ি জমান  সভ্যতার সূতিকাগার যুক্তরাজ্যে। দুই পত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক সৈয়দ আব্দুল মাবুদ এখন স্থায়ী ভাবে  বসবাস করেন টেমস নদীর কোল ঘেঁষা লন্ডনে। 

মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধ একটি জাতির জীবনের সবচেয়ে বড় জাতীয় আন্দোলন। এই আন্দোলন যুদ্ধে পরিণত হয় জাতীয় ভিত্তিতে। সেখানে কোনো দলের বা মতের প্রাধান্য থাকে না। স্বাধীনতার অভিন্ন লক্ষ্যে সকল মতামতের ভিন্নতা মুছে যায়।বিশ্বের সব দেশের  মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর স্বাধীন দেশে যে সরকার গঠন করা হয় তা  হয় জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে।জাতীয় সরকার।তারপর দেশের সংবিধান প্রণীত হয় ।বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রথা চালু করা হয়, এর পর দেশে আস্তে আস্তে গণতন্ত্রের পথে হাটতে শেখে।

  কিন্তু নির্মম পরিহাস এই যে ,পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তিতে নির্বাচিত গণপরিষদের সদস্যগণ ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন করেন। অথচ ঐ কলংকিত রাষ্ট্র কাঠামোর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল।এ ঘটনার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ  থেকে  ফিরে  স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রথম পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করি।এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করি। জেল জুলুম সহ্য করি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। বললেন  মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আব্দুল মাবুদ।

লন্ডন : ৩০.০৩.২০২১

শেখ মহিতুর রহমান বাবলু ( লেখক ,সাংবাদিক ,কলামিস্ট )