পলাশ রহমান: তাবলিগ জামায়াতকে আমি কোনো সংগঠন মনে করি না, বরং এটি একটি প্রতিষ্ঠান। বিশ্ব জুড়ে মুসলমানদের সবচেয়ে নিরাপদ এই প্রতিষ্ঠানটি সাধারণত কোথাও কোনো বাধা বিপত্তির মুখে পড়ে না। কারন ‘তাবলিগ জামায়াত’ নামের এই প্রতিষ্ঠানটি ইসলামের দাওয়াত দেয় ‘ধর্ম’ হিসাবে। অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামকেও ধর্ম হিসাবে মানতে, পালন করতে পৃথিবীর কোথাও কোনো বাধা বিপত্তির মুখে পড়তে হয় না। কেউ কোনো ওজন আপত্তি তোলে না। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাড়ায় যখন ইসলামকে কেউ ‘আদর্শ’ হিসাবে মানতে, পালন করতে অথবা দাওয়াত দিতে চায়।
আমরা যে তাবগিলের সাথে পরিচিত এই তাবলিগের জন্ম আমাদের উপমহাদেশের দেওবন্দি আলেমদের হাত ধরে, যার সূচনায় ছিলেন, হযরত ইলিয়াস রহ.। যদিও কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন বর্তমানের তাবলিগের সাথে ইলিয়াস রহ. এর তাবলিগি কার্যক্রমের বেশ ফারাক রয়েছে, তবু এর শুদ্ধতা নিয়ে কারো মধ্যে বিশেষ কোনো আপত্তি বা দ্বিমত নেই। যেমন মুসলমানদের অন্যান্য সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ে নিজেদের মধ্যেই ব্যাপক দ্বিধা সমালোচনা আছে, তাবলিগ জামায়াত নিয়ে তা নেই।
বিগত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে তাবলিগ জামায়াতের বিশ্ব আমির (জিম্মাদার) মাওলানা সাদকে নিয়ে দেওবন্দি আলেমদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ, অসন্তষ সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষোভের কারন হিসাবে জানা যায় তাবলিগের বিশ্ব আমির নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিগত দিনে যে নীতিমালা মানা হয়েছে মাওলানা সাদ তা অমান্য করেছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে ইসলাম সম্পর্কে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছেন। নিজের মত প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি ইসলামের মৌলিক আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক কথাবার্তা বলেছেন। এসব বিষয়ে ভারতের দেওবন্দ মাদরাসা থেকে তাকে বার বার সতর্ক করা হয়েছে। তার বিতর্কিত কথাগুলো ‘ভুল ছিল’ বলে স্বীকার করতে বলা হয়েছে। কিন্তু মাওলানা সাদ তা করেন নিই। তিনি নিজ বক্তব্যে অনড় রয়েছেন। (এসব বিষয়ে মাওলানা সাদের সরাসরি কোনো বক্তব্য আমার কাছে নেই, যে কারনে আলেমদের পক্ষ থেকে আপত্তি তোলা কথাগুলো উল্লেখ করা হলো না)
গেল বছর বিশ্ব ইজতেমায় সাদ সাহেবের আগমন এবং বক্তব্য রাখায় বাংলাদেশ এবং ভারতের দেওবন্দি আলেমদের মধ্যে আপত্তি ছিল, কিন্তু এতটা জোরালো ছিল না এবার যা হয়েছে। এবার আপত্তি তোলা আলেমরা এতটাই কঠর অবস্থান নিয়েছেন যে, তারা সাদ সাহেবের বাংলাদেশে আগমন রুখতে আমাদের সরকারের কাছে নালিশ নিয়ে গিয়েছেন। সেখানে খুব বেশি সুবিধা করতে না পেরে তারা রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। ১০ জানুয়ারী প্রায় অর্ধ দিবস তারা ঢাকার আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট অবরোধ করে রেখেছেন। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জায়গায়ও বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।
আমার প্রশ্ন হলো তাবলিগ তো রাজপথের কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন নয়, এটাকে কেনো রাজপথে নামিয়ে আনা হলো? কী লাভ হলো এয়ারপোর্ট অবরোধ করে? কারা এর পেছনে অতিউৎসাহী ভুমিকা রেখেছে? একজন সাদের কাছে আমাদের আলেমরা এত অসহায় কেনো?
সাদ সাহেব বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিবেন কী দিবেন না, বক্তব্য রাখবেন কী রাখবেন না, তা নির্ধারণের জন্য আপনাদের রাজপথে নামতে হলো কেনো? এটাতো তাবলিগের ঘরোয়া সিদ্ধান্তের বিষয়। ঘরোয়া ভাবে আপনারা এর সমাধান করতে পারলেন না কেনো? মূল সমস্যা কোথায়? এত কিসের অসহায়ত্ব আপনাদের? সরকারের কাছে দৌড়াতে হলো কেনো? তাবলিগ জামায়াত তো কোনো সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান নয়। সরকারকে কেনো সালিশ মানতে হলো? কারা এর পেছনে অতিউৎসাহি ভুমিকা রেখেছে?
বাংলাদেশের সরকার যে অনেক কিছুই স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না তা কী আপনাদের কাছে অজানা? সাদ সাহেব একজন ভারতি নাগরিক। তাকে নিয়ে বিতর্কের সূচনা ভারতেই। সুতরাং তাকে বাংলাদেশ সরকার ভিসা দিবে কী দিবে না সে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার কী স্বাধীন ভাবে নিতে পেরেছে? নাকি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ফরমায়েস মানতে হয়েছে সরকারকে তা কী আপনারা জানেন বা জানার চেষ্টা করেছেন?
উপরে বলেছি তাবলিগ জামায়াত মুসলমানদের সবচেয়ে নিরাপদ প্রতিষ্ঠান। তার মানে এটা নয় যে এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই! কেউ ষড়যন্ত্র করে না! মোসাদি ষড়যন্ত্র এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। সচেতন মহলের কাছে এর অনেক তথ্য প্রমান আছে। এই সুযোগে ‘র’ যে তাদের সাতে হাত মেলায়নি তার কী কোনো নিশ্চয়তা আছে?
সরকারের কাছে দৌড়া-দৌড়ি করে, সালিশ মেনে যখন সাদ সাহেবের বাংলাদেশে আগমন ঠেকাতে পারলেন না তখন কেনো দৌড়ে গেলেন এয়ারপোর্টে? কার বুদ্ধিতে? মাত্র কয়েক ঘন্টায় কি ভাবে এত মানুষ জড় হলো ওখানে? পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া তো এত অল্প সময়ে এত মানুষ জড় হওয়ার কথা নয়। কারা এর পেছনে অতিউৎসাহী ভূমিকা রেখেছে? কারা এর অর্থ যোগান দিয়েছে?
আপনারা যখন দেখলেন সরকার আপনাদের দাবী না রেখে সাদ সাহেবকে ভিসা দিয়েছে তখন কেনো এয়ারপোর্ট অবরোধ করার মতো হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে গেলেন? একজন সাদের জন্য দেশের এত এত মানুষকে কেনো বিপদে ফেললেন? আপনাদের ওই সমাবেশের কারনে কতো মানুষ হয়রানি হয়েছে, কতো মানুষ তাদের ফ্লাইট মিস করেছে, কতো মুমুর্ষ রোগী হাসপাতালে যেতে পারেনি তার কোনো খবর আছে আপনাদের কাছে? খবর নেয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করেছেন?
আপনাদের মাথায় কেনো এলো না যে এয়ারপোর্ট অবরোধ করে তাকে ঠেকানো যাবে না। তার সার্বিক নিরাপত্তা বাংলাদেশ সরকার নিশ্চিত করবে, কেনো আপনাদের মাথায় তা ধরলো না? কেনো আপনারা দেশের মানুষকে অযথা কষ্ট দিলেন? নাকি আপনারাও কোনো অদৃশ্য ইশারায় নেচেছেন?
কি লাভ হলো তাবলিগ জামায়াতকে রাস্তায় নামিয়ে? আপনাদের মধ্যে হয়তো কারো কারো ব্যক্তিগত লাভ কিছু হয়েছে, কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় কী কাজটা ভালো করেছেন? তাবলিগ জামায়াত শুধুমাত্র দাওয়াতের কাজ করে, প্রতিবাদ প্রতিরোধে তাদের পাওয়া যায় না, সুতরাং এই সুযোগে তাদের একটু নামিয়ে নিলেন, এমন নয়! তবে কেনো দেশের মানুষকে কষ্ট দিলেন? কেনো এত নগ্ন ভাবে আপনাদের অসহায়ত্ব তুলে ধরলেন? বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে হাসাহাসির পাত্র বানালেন?
সাদ সাহেব যখন আপনাদের কথা গ্রাহ্য করেন নিই, সরকার যখন আপনাদের কথা রাখে নিই, আপনারা কেনো ভিন্ন পথে হাটলেন না? দেশের সব শীর্ষ আলেমরা মিলে সাদ সাহেবকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন। সামনা-সামনি, সরাসরি কথা বলতেন। তিনি আপনাদের কতো জনের কথা অমান্য করতেন?! লেখিত ফতোয়া ছুড়ে ফেলা আর একগাদা মানুষের মুখের উপর ‘না’ বলা যে এক কথা নয়, তা কেনো আপনারা বুঝলেন না?
আপনাদের আপত্তির জায়গাগুলোয় তার ব্যাখ্যা সরাসরী জানতে চাইতেন। মিডিয়ায় তুলে ধরতেন। যদি কোনো ভাবেই তাকে বোঝানো সম্ভব না হতো তখন শক্তি খাটাতেন। তাকে বয়ান করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করতেন। কিন্তু সে পথে না গিয়ে আপনারা রাজপথে নামলেন কেনো? বিশ্বের সামনে কী নজির স্থাপন করলেন? একজন সাদের মোকাবিলায় আপনারা এত অসহায় কেনো? এত মানুষের আপত্তি নিয়ে সে তাবলিগের বিশ্ব আমির থাকে কী করে? তার খুটির জোর কোথায় এবং আপনাদের দূর্বলতা কোথায়?
তিনি বিশ্ব ইজতেমায় না গেলে, বয়ান না করলেই সব সমস্যায় সমাধান হয়ে যাবে? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারন আছে? আপনারা ইগো সমস্যায় ভুগছেন না তো? ভারতে যাদের কথা সাদ সাহেব অমান্য করেছেন তারা আপনাদের প্ররোচিত করেনি তো? আপনারা দাবার ঘুঁটি হননি তো?
খবরে দেখলাম কারা যেনো সাদ সাহেবের পক্ষ হয়ে বলেছে, বাংলাদেশ থেকে বিশ্ব ইজতেমা সরিয়ে নেবে। আপনাদের পক্ষ হয়ে বিশ্বের কে কী বলেছে? আপনাদের পাশে তো কাউকে দাড়াতে দেখলাম না। আপনারা কী কারো পতানো ফাদে জড়িয়ে গেলেন?
আপনারা যারা আজ তাবলিগ জামায়াতকে রাস্তায় নামিয়ে আনলেন কখনো কী ভেবেছেন হজের পরেই বিশ্বের সব চেয়ে বড় মুসলিম মহাসম্মেলন হয় বাংলাদেশে এটা কতো বড় গৌরবের, সম্মানের। এর অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করেছেন? দেশের অর্থনীতিতে এই মহাসম্মেলনের ভূমিকা কতোটা তা ভেবেছেন? আপনাদের কারনে বিশ্বের কাছে এই মহাসম্মেলনের গুরুত্ব কোথায় গিয়ে ঠেকলো তা কী একবারও ভেবেছেন? নাকি উঠলো বাই- চলো দরগায় যাই, এমন ভুমিকায় অবতির্ণ হলেন?
আপনারা যারা ১০ তারিখে হঠকারী কর্মসূচি পালন করেছেন, গলার রগ ফুলিয়ে চিল্লাপাল্লা করেছেন তাদের আমলনামাও তো খুব বেশি সুবিধের না। সারা দেশের মানুষকে আপনারা পর্দার ওয়াজ শোনান, গণতন্ত্রের কুফরি রুপ বয়ান করেন অথচ আপনাদেরই দেখা যায় হাসিনার পাশে, খালেদার পাশে। কেউ কেউ শাহবাগে গিয়ে জীবনের শ্রেষ্ট নেকি হাসিল করেন। আপনাদের নিয়েই তো আমরা বিভ্রান্ত। সাদ জটিলতা নিয়ে আপনাদের উপর ইমান রাখি কী করে?!
বছরখানেক আগে ইসলামি আন্দোলনের নেতা মুফতি ফয়জুল করিম তাবলিগ জামায়াতের কার্যক্রম নিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছিলেন সত্যি, কিন্তু তার বাচন ভঙ্গি, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ এত খারাপ ছিল যে তার সব ভালো কথাগুলো খারাপের নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। তার চোখে-মুখে ছিল ভয়ানক আক্রশ যা কোনো ইসলামি দাইর জন্য খুবই বেমানান।
সত্যি করে বলেন তো- আপনারা এত বিভ্রান্ত কেনো? এত আত্মবিশ্বাসের অভাব কেনো আপনাদের? এত কি অসহায়ত্বের মধ্যে হাবুডুবু খান আপনারা?
বিঃদ্রঃ যারা মনে করেন আলেমদের সমালোচনা করার অধিকার যোগ্যতা আমাদের নেই তারা এখান থেকে ৩১৩ কিলোমিটার দুরে থাকুন। কারন আপনাদের সমালোচনা করার যোগ্য অধিকার যদি আমাদের না থাকে, আমাদের সমালোচনা করার যোগ্যতা অধিকারও আপনাদের নেই। আপনারা আপনাদের নেতা/ওস্তাদদের ভুলে উর্ধে ভাবতে পারেন, আমরা পারি না।
লেখক ঃ পলাশ রহমান , প্রডিউচার, রেডিও বেইজ, ইতালি