আয়েবা সম্মেলনে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা-
লন্ডন থেকে শেখ মহিতুর রহমান বাবলু :: প্রেসিডেন্ট হোটেলের ১১ তলায় আমার থাকার ব্যবস্থা হলো। রুমে লাগজে রেখে নীচে এসে দেখি সে এক এলাহি কান্ড। ড. জয়নাল আবেদিনের নিজস্ব অর্থায়নে এথেন্স শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে আয়েবার অফিস থাকলেও প্রেসিডেন্ট হোটলের লাউঞ্জে তৈরী করা হয়েছে সুসজ্জিত অস্থায়ী অফিস, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, তথ্য কেন্দ্র ইত্যাদি। সার্বক্ষণিক নেট কানেকশন। থরে থরে ল্যাপটব, প্রিন্টার, স্ক্যানার লেমিনেটিং মেশিন, টেলিফোন, ফ্যাক্স, কাগজ কলম কি নেই সেখানে। বিগত কয়েকদিন ধরে ড. আবেদিনের সহকর্মিরা ঘর বাড়ী ছেড়ে পালাক্রমে ২৪ ঘন্টা অফিস করছে এখানে। আবার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু কারো মুখে কোন অভিযোগ নেই। নেই কোন অনুযোগ। কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করে চলেছে তারা। অঊইঅ সম্মেলনকে সার্থক করতে গিয়ে জীবনের সব আরাম হারাম করছে তারা।
এদিকে হোটেলের একটা এয়ারটাইড রুমে গড়ে তোলা হয়েছে মিডিয়া হাউস। রেকডিং প্যানেল এডিটিং প্যানেল- ল্যাপটব, ক্যামেরা, নেটলাইন সেখানে টেলিফোন সহ যাবতিয় সরঞ্জম রাখা হয়েছে সাংবাদিকদের সার্বক্ষণিক ব্যবহারের জন্য।
আমি সবার সাথে পরিচিত হয়ে নিজেও কাজে লেগে গেলাম। লন্ডন থেকে লিটন ভাই, ফ্রান্স থেকে কাজী এনায়েত উল্লাহ এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এথেন্সের সার্বিক পরিস্থিতি জানার জন্য আমার সাথে ইতিমধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছেন। সম্মেলন উপলক্ষে বাংলাদেশ ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক গুণি মানুষ আসবেন। বড় মাপের সংগঠক, হাই প্রোফাইল ব্যক্তিত্বদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠবে আয়েবা সম্মেলন। এতো সেলিব্রেটি ইউরোপের কোথাও একত্রিত হবার কোন নজির নেই। সুতরাং সম্মেলণের নিরাপত্তার ব্যাপারে আয়োজক কমিটির বিভিন্ন দেশের সদস্যরা। উদ্বিগ্ন সাধারণ মনে একটাই প্রশ্ন, তীর ভাংগা এই ঢেউয়ের সাগর কি পাড়ি দিতে পারবেন ড. আবেদিন এবং তার সঙ্গী সাথিরা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গ্রীসের প্রভাবশালী দু’জন মন্ত্রি উপস্থিত থাকবেন। এথেন্সে অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাসের মান্যবর রাষ্ট্রদূত সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। এ দিকে উচ্ছৃঙ্খল বিদ্রোহী বাংলাদেশীরা সম্মেলন স্থলে নাশকতা ছড়ানোর পাঁয়তারা করেই চলেছে। সার্বিক এসব পরিস্থিতি মাথায় রেখে ড. আবেদিন আগেই সব ব্যবস্থা চুড়ান্ত করে রেখছেন। তিনি আমাকে বললেন ভয় পাবার কোন কারণ নাই। যে দেবতা যে ফুলে তুষ্ট আমি তাকে সেই ফুল দেবার ব্যবস্থা করে রেখেছি। তিনি আরো বললেন ৩০ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশ, গোয়েন্দা বিভাগের লোক, নিরাপত্তা কর্মী এবং ডগস্কট দিয়ে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখা হবে। প্রেসিডেন্ট হোটেল অন্যায় ভাবে টু শব্দ করার সুযোগ থাকবে না কারো। সি.সি ক্যামেরার মাধ্যমেও মনিটরিং করা হবে চিহ্নিত সন্দেহ ভাজনদের গতিবিধি।
আমাকে নিরাপত্তা কর্মীদের নির্দেশনা ও সার্বিক সহযোগীতার দায়িত্ব দেয়া হলো। অঊইঅ সম্মেলনে সাংবাদিকতা ও ডেলিগেট হিসাবে দায়িত্ব পালনের সব আকাঙ্খা যে আমার ভেস্তে গেল বুঝতে বাকি রইল না।
হাসপাতালে, জেলখানা, পুলিশ স্টেশন সহ বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশীদের সাহার্যার্থে নিবেদিত প্রাণ হয়ে কাজ করেন সে। অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ হলেও আন্ডার টেকেন দিয়ে অনেক বাংলাদেশীকে পুলিশ ষ্টেশন ও হাজত খানা থেকে বের করে আনার নজির আছে এই সমাজ সেবকের । এথেন্সের আবহাওয়া দারুন। হোটেলের সামনে দাড়িয়ে আমি। চারিদিকে নির্মল বাতাস। খবর পেলাম গতরাত অজ্ঞাতনামা কিছু দুবৃত্তের হাতে ভিষণভাবে আহত হয়েছে এক বাংলাদেশী। মাদারিপুরের এই লোক অনেকদিন ধরে থাকেন এথেন্সে। রাতে কাজ থেকে ফেরার পথে দুবৃত্তরা লাঠি শোটার আঘাতে যখনম করে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে যায় রাস্তার ওপরে। জ্ঞান ফিরলে ভদ্রলোক নিজেকে আবিস্কার করেন হাসপাতালের বিছানায়। গ্রিসে অর্থনৈতিক মন্দা শুরুর পর থেকে এ খবর প্রায়ই শোনা যায়। দুঃখ জনক হলেও সত্য যে স্থানীয় প্রশাসন এ সব বিষয়গুলি একেবারেই না জানার ভান করে। এথেন্সের বাংলাদেশ দূতাবাস এ সব নির্যাতিতদের পাশে দাড়ানো মানবিক দায়িত্ব মনে করলেও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে তারাও দৃশ্যমান কিছুই করেন নাই।
বাংলাদেশ সমিতি গ্রীস এর সভাপতি নির্বাচিত হবার আগে থেকেই ড. জয়নাল আবেদিন কমিউনিটির মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হবার পর বাংলাদেশ সমিতির কোন সার্টিফিকেট প্রদান করে কোন রকম সহযোগীতা করে অসহায় মানুষের পকেট কাটার কোন নজির নেই। আমার জানামতে ইউরোপে এ ধরণের দৃষ্টান্ত দ্বিতীয়টি খুজে পাওয়া দায়। ড. আবেদিন নিজের গরজে এবং নিজের খরচে কমিউনিটির সেবায় উল্কার মতো ছুটে বেড়ান গ্রিসের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
দীঘদিন প্রবাসে থাকার পরেও ভাতের প্রতি আমাদের দুর্বলতা থেকেই যায়। আমি এ ব্যাপারে সতন্ত্র। যখন যে দেশে যাই ঐ দেশের খাবার খাওয়া স্থানীয় মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া, তাদের জীবন যাত্রা সম্পর্কে ধারণা নেওয়া আমার স্বভাব। দেশ বিদেশের খাবারের প্রতি আমার রয়েছে আলাদা আকর্ষন। আমি ইতালীয়ান ফুডের উপর লেখাপড়া করেছি। দীর্ঘদিন এই সেক্টরে কাজও করেছি। সম্প্রতি ইতালীয়ান ফুডের উপর একটা বই লেখার কাজে হাত দিয়েছি।
গ্রীসের ভিষণ জনপ্রিয় খাবারের নাম গিরোস। সন্ধার পর আয়েবা গ্রীস আয়োজকদের একজন রাসেলকে বললাম গিরোস পাওয়া যাবে কোথায়? সে অতি উৎসাতে লেজ উঁচু করে গাড়ী আনতে পার্কিং দিকে দৌড়ে গেল। রাজু, সাগর রিপন ওরাও সঙ্গী হলো। সবাই স্থানীয় আয়োজক কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। অনেক ঘুরাঘুরি করে রাসেল শহরের সেরা গিরোস বিক্রির রেষ্টুরেন্টে নিয়ে গেল। সবাই অর্ডার দিল দুটো করে। আমি একটা। ওয়েটার গিরোস পরিবেশন করলেন। আমি খানিকটা বিস্মিত হলাম।
সব মানুষের জীবনে ছোট বড় বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। সাময়িকভাবে বিস্মিত হয় মানুষ। পরে আবার ভুলে যায় । আমার জীবনেও বিস্ময়কর ঘটনা কম ঘটেনি। ফ্রান্সের দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা আমাকে আন্দোলিত করে।
প্রথমবার মোনালিসার কালজয়ী হাসি দেখতে প্যারিসে লুভর যাদুঘরে মোনালিসার ছবির সামনে পৌঁছে বিস্মিত হয়েছিলাম। বিশ্বনন্দিত মোনালিসার ছবি? আমি গরীব দেশের মানুষ। কিন্তু আমাদের দেশেও সচারচার মোনালিসার বিরাট বিরাট সুন্দর ছবি দেকা যায়। লুভর যাদুঘরটিতেও হাজার হাজার কিং সাইজের ছবি ছিল কিন্তু মোনালিসার আসল ছবি এত ছোট খাট হতে পারে ভাবতেও পারিনি। তাই ক্ষণিকের জন্য বিস্মিত হয়েছিলাম।
আর একবার ফ্রান্সে ক্যাম্পিয়ন হৃদের ষ্টার্জন মাছের ডিম ক্যাভিয়ার খেয়ে মনে হয়েছিল ধুর ছাই। এর চাইতে পদ্মার ইলিশের ডিম কত সুস্বাদু। অথচ ষ্টার্জন মাছের ডিম পৃথিবীর দুর্বল খাদ্যের একটি।
দেশে থাকতে মনে হতো বিহারীরাই সব চাইতে ভাল রুটি বানায়। বিদেশে আসার পর থেকে সে ধারণা বদলে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের কোল ঘেষে আফ্রিকার কিছু দেশ রুটি তৈরীর রাজা। কত ধরণের রুটি যে এরা খায় বলে শেষ করা যাবে না। ইতালীয়ান পিজাও এক ধরণের রুটি। মিশরীয় সভ্যতায় খামিরের সাথে ইষ্ট ব্যবহারের ঐতিহ্য। সর্বাধিক প্রাচীন বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
গিরোসও এক ধরণের রুটি। যা বাণিজ্যিকভাবে কারখানায় তৈরি হয়। রুটির মধ্যে তুরস্কের বিখ্যাত ডোনার কাবাবের মাংস, সব্জি ও এক ধরণের সস দিয়ে রোল করে পরিবেশন করে। গিরোস খেতে সুস্বাদু। তবে যে পরিমাণ হাক-ডাক সেই তুলনায় তেমন কিছূই না। (চলবে)।
লন্ডনশেখ মহিতুর রহমান বাবলু
১৮/০১/২০১২ সাংবাদিক/ লেখক