এথেন্সের পথে পথে বাংলাদেশীদের আর্তনাদ ( 2 )

977 Visited

22 Sep
এথেন্সের পথে পথে বাংলাদেশীদের আর্তনাদ ( 2 )

ডেলিগেট, সাংবাদিক ও পুরষ্কারপ্রাপ্তদের পদচারনায় মুখরিত AEBA সম্মেলন ,
লন্ডন থেকে শেখ মহিতুর রহমান বাবলু :: AEBA কনভেনশন উপলক্ষে এথেন্স বিমান বন্দরে তৈরী অভ্যর্থনা ডেস্ক ও প্রেসিডেন্ট হোটেলের অস্থায়ী অফিসে কর্মরতরা ভীষন ব্যস্ত। এদিকে গাড়ী চালকের দায়িত্ব প্রাপ্তদের দৌড় ঝাপের কোন শেষ নেই। ঘন্টায় ঘন্টায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসছেন ডেলিগেট, সাংবাদিক ও পুরষ্কারপ্রাপ্তরা। বাংলাদেশ থেকেও আসছেন সাংবাদিক ও মাইগ্রান্ট বিশেষজ্ঞরা। বিমানবন্দরে কেউ পৌছা মাত্রই খবরটি পৌছে যাচ্ছে হোটেলের অস্থায়ী অফিসে। সংগে সংগে অতিথিদের থাকার রুম ,ছবিসহ ডেলিগেট/সাংবাদিক কার্ড ও স্থানীয় সিম কার্ড ইত্যাদি তৈরীতে ব্যস্ত অস্থায়ী অফিসের কর্মকর্তারা। সবার কাজ ও দায়িত্ব ভিন্ন ভিন্ন। মেশিনের মতো কাজ করে চলেছে সবাই। কোথাও ছন্দের কোন পতন নেই। ড. জয়নাল আবেদিন একবার হোটেলে একবার বিমানবন্দরে ছুটাছুটি করছেন।  সব কাজ চলছে কম্পিউটারের ডিস্কে গাথা ডাটার মতো।
 
ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগের প্রধান, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন গবেষক প্রফেসর ড. অসিম কুমার দত্ত রয়, পোল্যান্ড থেকে সাবেক সাংসদ ড. রনজন কস্তা, স্কটল্যান্ড থেকে বাংলাদেশ ফেডারেশন অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজের চেয়ারম্যান ড. ওয়ালী তাসর উদ্দীন, চেক রিপাবলিকের লেবার মিনিষ্ট্রির এক্সিকিউটিভ অফিসারনাদিরা মজুমদার, ফ্রান্স বাংলাদেশ ইকোনোমিক চেম্বারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাজি এনায়েত উল্লাহ ইনু, পোল্যান্ড থেকে বালাদেশের ওয়ানারারী কাউন্সিলর জেনারেল ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক, সুইডেন থেকে স্বনামধন্য মুক্তিযোদ্ধা,শহিদুল হক মামা, নরওয়ের ইমিগ্রেশন ডাইরেক্টর হাসিব রহমান, স্পেনের জাতীয় শিল্পী মনিরুল ইসলাম, ডেনমার্ক থেকে গ্রিনিজ রেকর্ড হোল্ডার শিল্পী রুহুল আমিন কাজল, যুক্তরাজ্য থেকে সামসুল আলম লিটন, আশরাফ উদ্দীন, simple কলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওফল জামির, ইকবাল ফেরদাউস, ব্রিটিশ ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের পরিচালক ফরিদ নাবির, বিয়ানী বাজার ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের সভাপতি মুহিবুর রহমান মুহিব, গোলাম মোস্তফা, ব্যারিষ্টার নাজির আহমেদ, চ্যানেল এস এর Chairman সামাদ চৌধুরীসহ ৫৩ টি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সংগঠকরা ইতিমধ্যে AEBA  কনভেনশনে যোগ দেবার জন্য প্রেসিডেন্ট হোটেলে এসে পৌছেছেন। চারিদিকে উৎসবের আমেজ।
ইতালী থেকে আসা সাংবাদিক মাইনুল ইসলাম নাসিমের আয়েবা সম্মেলনে রয়েছে বিশাল অবদান। নাসিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, গ্রীসের আঃলীগ, যুবলীগ, বি.এন.পি., জাতীয় পার্টিসহ সকল সামাজিক ও আঞ্চলিক সংগঠনের, এমন কি এথেন্সের একমাত্র বাংলা স্কুল পরিচালিত হয় যে “দোয়েল” নামক সংঠনের মাধ্যমে এদের উর্ধতম সহ সকলেই আয়েবা সম্মেলনকে সার্থক করতে দল মত নির্বিশেষে কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু সম্মেলনের বিরোধিতা যারা করছে তাদের আইডেনটিটি কি? বিজ্ঞের হাসি হেসে নাসিম বললেন ওরা কুড়াল পার্টি বাবলু ভাই। জিজ্ঞাসা করলাম কুড়াল পার্টি আবার কি? উত্তরে নাসিম বললএক সময় কিছু ডান্ডাবাজ কুড়ালের ভয় দেখিয়ে নবাগতদের কাছ থেকে চাদা আদায় করত। মাস শেষে বেতন নিয়ে ঘরে ফেরার সময় কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার ভয় দেখিয়ে সর্বস্ব লুটে নিত এই চক্রটি। ড. জয়নাল আবেদিনের হস্তক্ষেপে এথেন্সের বাংলাদেশীরা এখন নিরাপদ। সুতরাং ড. আবেদিনের সব ভালো কাজেই ওদের গাত্রদাহ । আয়েবা সম্মেলন উপলক্ষে যে প্রপাকান্ড সেটা একমাত্র ক্ষমতার লোভ ও ড. আবেদিনের সাহসী পদক্ষেপের বিপক্ষে অস্থান ছাড়া আর কিছু না।
 
ইউরোপের প্রতিটা দেশে কিছু লোক বাংলাদেশের রাজনীতির চর্চা করে। এদের কেউ আঃলীগ, বি.এন.পি., জাতীয় পার্টি কেউবা জামাত পনথী। এরা দেশের রাজনৈতিক ভেদবুদ্ধি নিয়ে একদলের সমর্থক অন্যদলের সমর্থকদের সাথে পারষ্পরিক বিবাদে লিপ্ত হয়। একে অপরকে সম্মান করার শোভনতা এদের মধ্যে নেই। একমাত্র আঃলীগের নেতাকর্মীরা দল নিয়ে ভাবে। বাকী সবাই দল বা দেশ কোনটাই নিয়ে ভাবে না। এদের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু শুধুই ক্ষমতা। আমি বিশ্বের কোথাও বাংলাদেশী ছাড়া অন্যদেশীদেরকে, দেশের বাইরে অবৈধভাবে নিজ দেশের রাজনীতি নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে দেখিনি।
 
বাংলাদেশ থেকে দলীয় নেতারা আসেন অধিকাংশ সময় প্রবাসীদের অর্থে। সংবর্ধিত হন তারা, হাতিয়ে নেন নগদ অর্থ ও উপঢৌকন, আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে জাতীকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য দলীয় নেতা কর্মীদের শিখিয়ে দিয়ে যান ঘৃণা ও বিদ্বেষ। বাংলাদেশী সব দলের নেতাদের মুখে শোনা যায় এক এবং অভিন গতবাধা কিছু কথা। বিগত সরকারের আমল ছিলো খারাপ। এখন দেশ ও দেশের মানুষ সুখ ও শান্তিতে আছে। তারা আরো বলেন অতীতে দেশে গনতন্ত্র ছিলো না। এখন দেশে গনতন্ত্রের তুফান বইছে। অতীতে দেশে অর্থনৈতিক মুক্তি ও বাক স্বাধীনতা ছিলো না। এখন দেশের মানুষ স্বচ্ছল, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করছে সবাই। অতীতে সন্ত্রাস, যঙ্গিবাদ, ধর্ষন লুন্ঠনে দেশ সয়ল্যাব ছিলো, এখন দেশে এসব নেই। অতীতের সরকার ছিলো চোর, বর্তমান সরকার সাধু। এভাবে পাইকারী দরে অতীতকে দোষারপ করে বর্তমানকে সম্মানিত করার চেষ্টা চালায় ঐ সব নেতারা, যারা কিনা দেশের ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ধারন করে।
 
কিছুদিন আগে লন্ডনে একটি দলীয় অনুষ্ঠানে দেশের ১ম শ্রেনীর একজন মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলাম,অর্থের অভাবে বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। দলীয় সন্ত্রাস ও ধর্ষনের খবর প্রায় প্রতিদিন শোনা যায়। পুলিশকে প্রকাশ্যে দলের বি টিম হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?
 
ভদ্রমহিলা তখন পুরনো কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করলেন। বললেন, অর্থনৈতিক বিপর্যয় আছে কিন্তু পূর্বের তুলনায় অনেক কম। সন্ত্রাস অতীতে ছিলো কিন্তু বর্তমানে দেশে সন্ত্রাসবাদ নেই বলেই চলে। বিরোধী দলের কন্ঠ আগে চেপে ধরা হতো। কিন্তু এখনতো দেশে গনতন্ত্র দৃশ্যমান। বিরোধী দলের বিপক্ষে কোন অভিমান এ সরকারের নেই। যা করা হয় তা শুধু জনগনের নিরাপত্তার স্বার্থেই।
 
আমি আবার প্রশ্ন করলাম বিগত সরকারের সব কিছু খারাপ ছিলো বলেই বর্তমান সরকার ক্ষমতায়। সুতরাং বিগত সরকারের কথা বাদ দিয়ে নিজেদের কথা বলুন। এবারের প্রশ্নটি শুনে ভদ্রমহিলা আমার উপর চড়াও হয়ে বললেন, বর্তমান সরকারের কোন ব্যর্থতা নেই। চড়াও হয়েছিলেন স্থানীয় দলের নেতা কর্মীরাও। আমি ভয়ে আর প্রশ্ন করার সাহস দেখাইনি।
 
দেশের মতো প্রবাসেও রাজনীতিতে বিরোধীদলের প্রতি আক্রোশ ও বিভাজনতো আছেই, আবার একই রাজনৈতিক দলের মধ্যেও আছে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে বিভেদ। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। তাদের কাছে দেশ বা রাজনৈতিক আদর্শ মোটেও বড় কথা নয়। প্রবাসীদের সামনে কে নেতৃস্থানীয় হতে পারলো সেটাই মুখ্য।
 
এথেন্সের আয়বা সম্মেলন ছিলো এই গতানুগতিক ধারাবাহিকতার বিপরীতে। সেদেশের সব বাংলাদেশী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ড. আবেদিনের নেতৃত্বে মিলে মিশে কাজ করতে দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়ে ছিলাম। মনে মনে বলেছিলাম, ইশ! এমন একটি দৃশ্য যদি বাংলাদেশে দেখা যেত তবে বাংলাদেশ নামক যুবকটিকে ঘুরে দাড়াতে বেশী সময় নিতে হতো না। হিসাব করে দেখেছি আমাদের মধ্যে সম্মানবোধের অভাব খুবই প্রকট। আমার হিসাবে এর হাত থেকে বাচতে হলে নতুন প্রজন্মকেই উদ্দ্যেগী হতে হবে। বুড়োদের দিয়ে আর দেশে ভালো কিছু হবার সম্ভাবনা নেই। দেশ বাচাতে হলে প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের উত্থান। প্রবীন নেতাদের কার্যকলাপ দেখলে মনে হয় এরা পাগল হয়ে গেছে।
 
গ্রীসের বিভিন্ন জেলখানায় বর্তমানে আটক আছে ৩৩২ জন বাংলাদেশী। এদের অধিকাংসই দেশে যেতে বাধ্য। যাদের পাসপোর্ট আছে তারা দূতাবাসের সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন মনে করে না। তবে যাদের পাসপোর্ট নেই ওরা 26 ইউরোর বিনিময়ে দূতাবাস থেকে সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে দেশে যেতে পারে। কথাগুলো বললেন, বাংলাদেশ দূতাবাস এথেন্সের কনসুলার জামাল হোসেন। গ্রীসের বাংলাদেশীদের দুর্দশার কথা শুনে দূতাবাসে গিয়েছিলাম জনাব হোসেনের সাথে কথা বলতে। দীর্ঘ সময় সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথা হয় তার সাথে। অনেক কনফিডেন্ট ও সাবলিল ভাষায় কথা বলেন তিনি।
 পৃথিবীর সব জীবজন্তুর সাথে মানুষকে যে বিষয়টি পৃথক করে তা হচ্ছে বিবেকের শক্তি, মানবিক আচরন, দায়িত্বজ্ঞান ও জ্ঞানের ভূষন। জামাল হোসেনের সাথে কথা বলার সময় এই চিরন্তন সত্য কথাগুলো বার বার মনে পড়ছিলো আমার।
(চলবে)             

শেখ মহিতুর রহমান বাবলু
লন্ডন
৩০.০৩.১৩    
সাংবাদিক/লেখক
E-mail: bablulondon@gmail.com