শেখ মহিতুর রহমান বাবলু : তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটা দেশের প্রতিটা পরিবারের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তাদের ছেলে মেয়ে । মানব জীবনের প্রথম ও প্রধান বিদ্যাপীঠের নাম পরিবার।পরিবার থেকে কোনো শিশু যদি সঠিক দিকনির্দেশনা না পায় তাহলে সে বিপদগামী হবে এতে অবাক হবার কিছুই নেই । একটি পরিবারের ডাইনিং টেবিল হচ্ছে তাদের সংসদ। এ সংসদে প্রতিদিন অন্তত একবার বসা উচিত , আলোচনা হওয়া উচিত পরিবারের খুঁটিনাটি সব বিষয় নিয়ে ।তবেই পারিবারিক মূল্যবোধ ধীরে ধীরে জীবনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসতে পারে।যার মধ্যে ফ্যামিলি ভ্যালু অর্থাৎ পারিবারিক মূল্যবোধ জাগ্রত, সে সহজে বিপদগামী হতে পারে না।
আমি ইউরোপের বহু দেশ ঘুরেছি। বিশেষ করে বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকাতে যাওয়া পড়েছে বেশ। আমার দেখামতে ইউরোপের অন্নান্য দেশের তুলনায় বিলেতে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণ ও যুবসমাজ সর্বাধিক বিপদগামী। এ দৃশ্য এখন বাংলাদেশের বড় বড় শহরেও ভুরি ভুরি চোখে পড়ে। সামাজিক এ অবক্ষয়ের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি বিভিন্ন বয়সী ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলেছি। এ ছাড়া কথা বলেছি শিক্ষক ,মসজিদের ঈমাম,অন্য ধর্মের ধর্ম গুরু, শিশু মনোবিজ্ঞানী ,অবিভাবক ও সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে। নতুন প্রজন্ম বিপদগামী হওয়ার গোড়ার কথা জানতে চেষ্টা করেছি।
ইউরোপের যেকোনো দেশের তুলনায় বিলেতে ধর্ম চর্চার সুযোগ বেশী। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ সুযোগ বাংলাদেশের চাইতেও ব্যাপক বললে সত্যের অবলাপ হবে না। সবধর্মই পৃথিবীতে এসেছে মানবতার মুক্তির জন্য। ধর্ম মানুষকে শৃঙ্খলা শেখায়।সামাজিক ও মানবিক হতে উদ্ভুদ্ধ করে। পরিমিত বোধের দীক্ষা দেয়। ধর্ম আছে বলেই পৃথিবীতে আজও মানবতার সুগন্ধ পাওয়া যায়। কোনো ধর্মই ব্যক্তি ,পরিবার ,সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে অশান্তির বিষবৃক্ষ রোপনের শিক্ষা দেয় না। সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার অভাবেই আমাদের যুবসমাজের এই দুর্দশা, বললেন মসজিদের ঈমাম ।
লন্ডনে একাধিক ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের মাঝে আমার একটা ফিশ এন্ড চিপস এর ব্যাবসা ছিল। পাশে বসবাস করতেন বাংলাদেশী কিছু পরিবার।ঐ পরিবারগুলোর ছেলে মেয়াদের অনেকে প্রায় প্রতিদিন, এমনকি ছুটির দিনেও আমার দোকান থেকে খাবার কিনে খেত। একদিন কৌতহলী হয়ে কথা বলেছিলাম ওদের অবিভাবকদের সাথে। জানতে চেছিলাম বাচ্চারা কেন প্রায় প্রতিদিন ফিশ এন্ড চিপস খায়। বাবারা বললেন ,আমি সারাদিন জীবিকার সন্ধানে ছুটে বেড়াই। ওদের মা ঘরে বসে উপভোগ করে ভারতীয় হিন্দি ও বাংলা সিরিয়াল। এদিকে সন্তানেরা আমাদের খাবার খেতে চাই না। স্বাস্থকর খাবার প্রতিদিন বাইরে থেকে কেনা সম্ভব হয়ে ওঠে না। সুতরাং চিকেন চিপস ছাড়া উপায় কি বলুন ?
মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় তরুণ কাল। জীবনের ভীত তৈরী হয় শৈশবে আর তা বিকশিত হয় তরুণ কালে। এ সময়েই সৃজনশীলতার উদ্ভাবন ঘটে। জীবনযাপনের প্রস্তুতির সময় এটা। জীবনকে শত ধারায় প্রস্ফুটিত করে সোনালী ভবিষ্যতের নির্মাণ কাজ শুরু হয় তরুণ কাল থেকে।এ সময়ে নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠে স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পন্ন মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। পাহাড় সমান বাধা অতিক্রমের স্পর্ধা দেখাতে পারে একমাত্র তরুণরা। দেশ ও জাতির সঙ্কটময় মুহূর্তে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসে তরুণরা। দেশমাতৃকার সম্মান রক্ষার্থে জীবন বিপন্ন করতেও কুন্ঠিত হয় না তারা। শত্রুর বুলেট তাদের পথ রোধ করতে পারে না। তাদের রক্তে স্নান করে পবিত্র হয় মাতৃভূমি। বায়ান্ন ,ঊনসত্তর ও একাত্তরে আমরা বাংলাদেশী তরুণদের অমিত তেজের পরিচয় পেয়েছি।
আবার সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে এই তরুণরাই হয় পথভ্রষ্ট। বিরূপ পরিবেশে তারা বিচ্যুত হয়ে পড়ে জীবনের লক্ষ্যবস্তু থেকে। তাদের সঠিক ভূমিকার অভাবে দেশ ও জাতি হয় বিপযস্থ। একটি সমাজের উন্নতি অবনতি সবই নির্ভর করে সে সমাজের তরুণদের উপর। কিন্তু এদের মূল্য বোধের অবক্ষয় দেখলে শঙ্কিত হয় সমাজ । আজকে আমরা নৈরাজ্যের অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণপোকার মতো বাসা বেঁধেছে দুর্নীতি। এ সময় তো তরুণদের নীরব থাকার কথা না। কেন তারা জাগছে না। তবে কি তারাও স্রোতে ভাসা শেওলার মতো অসুস্থ সমাজের প্রবাহমানতায় গা এলিয়ে দিয়েছে ?
ঘরের ও বাইরের উভয় পরিবেশ যখন তরুণ মনের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ,তখনই তরুণরা বিপথগামী হয়, বললেন এক শিশু বিজ্ঞানী।
অল্প বয়সের তরুণ অর্থাৎ কিশোরের অনেক রকম চাহিদা থাকে। এর মধ্যে স্নেহ ভালোবাসার চাহিদাটাই প্রবল। অস্বাস্থ্যকর গৃহ পরিবেশে কিশোর কিশোরীদের অপরাধপ্রবন করে তোলে। কলহপ্রিয় বাবামায়ের সন্তানদের কক্ষনো সুস্থ মানসিকতা গড়ে ওঠে না। বাবামার স্নেহবঞ্চিত ছেলেমেয়েরাই সবচেয়ে বেশি পথভ্রষ্ট হয় বলে মনে করেন মোনো বিজ্ঞানীরা ।
শহরায়ণ শিল্পয়ণের ফলে ঐতিহ্যবাহী যৌথ পরিবার ভেঙে আজ অণুপরিবার গঠিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক কারণেই বাবা মা দুজনকেই বাইরে কাজ করতে হচ্ছে। এসব পরিবারের শিশু কিশোররা বাবা মার্ স্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। অনেক পরিবারে খোঁজ খবর নেয়াই হয়না তাদের কিশোর বা তরুণ ছেলে মেয়ে কোথায় যায় ,কাদের সাথে মেশে। পরিবারের বয়জোষ্ঠদের দায়িত্বহীনতা তরুণদের বিপথগামী করে তুলছে। আবার অতিরিক্ত আদরে লালিত পালিত সন্তানরাও স্বার্থপরতা আক্রমণাত্মক মনোভাবাপন্ন হয়ে গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন অনেক শিক্ষক ।
মানব সন্তানের প্রাথমিক শিক্ষাদানের কাজটি চলে পরিবারে। আদিকালে তো মানুষ পারিবারিক পরিমন্ডলেই শিক্ষা লাভ করতো। আধুনিক সুশীল সমাজে রাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান শিক্ষা দানের কাজটি গ্রহণ করেছে। তবুও সন্তানের ব্যাক্তিত্ব গঠনে পারিবারিক শিক্ষা এক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। পরিবারের বয়োজোষ্ঠরা ছেলে মেয়াদের সুস্থ মানুষিক বিকাশে তথা ভারসাম্যপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখে। বয়স্কদের দায়িত্বহীনতায় ছেলে মেয়েরা হয় বিপথগামী এমনটি মনে করেন অনেক অবিভাবক ।
তরুণকালে ঘরের চেয়ে বাইরের পরিবেশই আকর্ষণ করে বেশি। তাদের মনোজগতে বহির্জগতের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। তরুণরা সাধাণরত বীর পূজারী হয়ে থাকে। সিনেমার হিরো ,জনপ্রিয় খেলোয়াড় এরাই তরুণদের কাছে আদর্শ স্থানীয় ।তাদের অধিকাংশ পছন্দের তালিকায় কবি সাহিত্যিক রাজনীতিকদের স্থান নেই। আমাদের জাতীয় বীরদের জীবনকাহিনী তাদের কাছে অজ্ঞ।দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে তাদের পরিচয় খুব কম।
দেশে বিদেশে আজ সর্বগ্রাসী নেশার কবলে পড়ছে কিছু যুব সমাজ। অনেকে বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে সৌখিনভাবে খেতে শুরু করে শেষ পর্যন্ত হয়ে পড়ে নেশা গ্রস্থ। কিন্তু অধিকাংশই হতাশা ,পরিবারের অশান্তি ,পরিবার থেকে বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি কারণে মাদসাক্ত হয়ে পড়ে। নেশার জগতে ডুবে আছে এমন অনেকের সাথে কথা বলে যা জেনেছি প্রশ্ন উত্তর আকারে তার কিছু অংশ সরাসরি তুলে ধরছি :
প্রশ্ন :নেশা করেন কেন ?
উত্তর :ভালো লাগে। মনে ফুর্তি পাই। আর এটাকে নেশা বলছেন কেন ? একটু আধটু খেলেই কি নেশা হয়ে যায়।তাছাড়া এখন খাবোনা তো বুড়া বয়সে খাবো।
প্রশ্ন : অর্থ কোথায় পান :
উত্তর : বাবা অঢেল পয়সার মালিক। কে খাবে এতো সব।তাছাড়া নিজেও উপার্জন করি। পয়সা কোনো সমস্যা না।
প্রশ্ন : সমস্যা কি :
উত্তর : সব সময় হাতের কাছে মাল পাওয়া যায় না।
প্রশ্ন : পুলিশের ভয় করে না ?
উত্তর : একটু হেসে, না।
প্রশ্ন :কোথা থেকে সংগ্রহ করেন ?
উত্তর : বলা যাবে না। বিভিন্ন পয়েন্ট আছে। যারা এগুলো বিক্রি করে তারা আমাদের চোখের ভাষা বোঝে। আমরাও বুঝি তাদের চোখের ভাষা। সুতরাং সমস্যা হয় না। হাটতে চলতে সবার সামনে লেন দেন হয় কেউ বুজতে পারে না।
প্রশ্ন : কিভাবে খাওয়া শুরু করলেন ?
উত্তর : আমার পারিবারিক অশান্তির কথা শুনে বন্ধুরা একদিন অফার করলো। বললো খেয়ে দেখ সব ভুলে যাবি। প্রথমদিন খেয়ে দেখলাম ভালোই লাগে।কোনো অশান্তির কথা মনেই থাকে না। শরীরটা হালকা হালকা মনে হলো। মনে হলো আমিই রাজা। এরপর থেকে কোনো কারণে মন খারাপ হলেই ওদের কাছে আসতাম , খেতাম। এভাবেই নেশার জগতে ডুবে গেছি। এখন আর বেরুতে মন চায় না ।
প্রশ্ন : আপনি কি এ জগৎ থেকে সত্যি মুক্তি চান না ? আপনাদের নিরাময়ের জন্য এদেশে অনেক সুযোগ করে রেখেছে সরকার।এগুলো গ্রহণ করেন না কেন ?
উত্তর : নেশা করলেও মরবো না করলেও মরবো। সুতরাং ছেড়ে কি লাভ ?
আমি যাদের সাথে কথা বলেছি ওই সব যুবক যুবতী প্রত্যেকেই সচ্ছল পরিবারের শিক্ষিত সন্তান।সবার উত্তরও প্রায় একই রকম। এরা সব কিছুই বোঝে। তারপরেও পারিবারিক ও মানুষিক অশান্তি আর ফিলিংস নামক শব্দটির সৎব্যাবহারের জন্যই তারা নেশা করে।
পৃথিবীর আয়ু বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাচ্ছে আমাদের সামনে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের শেষ পর্যন্ত কোন দিগন্তে নিয়ে যাবে সেটা ধারণার অতীত। এক পা দু পা করে আমরা সভ্যতার একেকটি স্তর পার হয়ে যাচ্ছি। প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। আবার আমাদের কাছ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধে কেড়ে নিয়েছে। এ কথা আমি বলতে চাই না যে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের সমাজের জন্য অপ্রয়োজনীয়। সভ্যতার উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তির অবদান অপূরণীয়। কিন্তু আমরা কি কখনো অনুধাবন করে দেখেছি যে প্রযুক্তির অকল্যাণকর দিকগুলো আমাদের অবস্থান কোথায় নামিয়ে দিচ্ছে? অবশ্য এর জন্য আবিষ্কার ও আবিষ্কারক কোনোটিই অপরাধী নয়, অপরাধী হচ্ছি আমরা ব্যবহারকারীরা।
এর প্রতিকার হিসেবে ইন্টারনেট ও অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই | মাদক ও সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে উপযুক্ত আইন ও তার বাস্তবায়নের ব্যবস্থা এদেশে আছে | পাশাপাশি পরিবারের অপ্রাপ্তবয়স্ক সদস্যদের ওপর বড়দের নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণও বাড়াতে হবে | বাড়াতে হবে সন্তানের জন্য আদর ভালোবাসা ও সঙ্গ দেবার ব্যাপারটিও। এভাবেই গড়ে উঠতে পারে একটি সুন্দর পরিবার ,সুন্দর সমাজ ও সুন্দর সুন্দর নতুন প্রজন্ম |
London 16.02 2020
শেখ মহিতুর রহমান বাবলু ,Sheikh Mohitur Rahman Bablu
লেখক : Editor Newslife24.com, কলামিস্ট
Published : Newslife24.com