আমার ছেলে ইয়ানের বয়স তার আট, বয়স কম হলেও বুদ্ধিদীপ্ততায় অসাধারণ। কাপড় চোপড় নিয়ে তার কখনো বাহানা নেই, খেলনার যে কোনো জিনিস হলেই হলো তার আর কোনো চাহিদা নেই। কিছুক্ষণ পর পর সে আমার কাছে এসে হিসেব কষছে আর বলছে, আর কয় রোজা পার হলে ঈদ। সে ভাবে ঈদ মানে সালামি। আমি মনোযোগ দিয়ে তার ঈদ উচ্ছ্বাস দেখছি আর খুঁজছি তার মাঝে আমার ছেলেবেলাকে।
না, পাচ্ছি না খুঁজে আমার সেই ছেলেবেলা, আমার উচ্ছ্বাস, আমার ঈদের শৈশবকাল। নেই প্রাণের স্পন্দন। মনে পড়ছে আজ আমার ছোটবেলার এক বৃষ্টির ঈদের কথা। ঈদ মানে আমাদের কাছে নতুন পোশাক, নতুন জুতা, পাডা প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে বেড়ানো আর কে কতো সালামি পেয়েছে তার প্রতিযোগিতা। শহুরে পরিবেশে বড় হলেও গ্রাম আমাকে বেশি টানতো। ঈদ মানে দাদার বাডি আর নানার বাডি। ঈদ করতে গিয়েছিলাম গ্রামের বাড়িতে। ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে টানা বৃষ্টি, মন ভীষন রকম খারাপ, ঈদের দিন বৃষ্টি হলে আমার কি হবে?
আমার কষ্ট কে আর দেখে, এতো সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় পডে বের হতে পারবো না। বিশেষ করে নতুন জুতা। বৃষ্টিতে গ্রামের পথ মানে মাটির সাথে বৃষ্টির জলের মাখামাখি করুন পথ, সেই পথ দিয়ে নতুন জুতো পডে হাঁটব? স্বপ্নে ভাবতে পারছিলাম না। এই জুতো কিনার পর আমি বিছানার উপর পরে হেঁটেছি যাতে ময়লা না লাগে, ভাবতেই হাসি পাচ্ছে, কতটা উন্মাদ আর উচ্ছাসে ভরপুর ছিলো
ছোটবেলার ঈদ। আদরের মেয়ে ছিলাম বলে ঈদের কাপড় চোপড় ভালই কেনা হত, ঈদের দিন সকালে গোসলের পর যে জামাটা পড়তাম সেটা আমার মা ঈদের আগেরদিন সেলাই করতো। অনেক যত্ন করে ডিজাইন দিয়ে সেলাই করতেন সেই বৃষ্টির সকালেও মার তৈরি ড্রেসটা পড়লাম আর জানালার কাছে দাঁডিয়ে আকাশের কান্না দেখছি, সাথে আমার চোখেও বইছিল বৃষ্টিধারা। অথচ এই বৃষ্টিধারা আজও বইছে কিন্তু আজ মন খারাপ অন্য কারণে, তাদের জন্য যারা আজ আমাদের মাঝে থেকে ঈদ উদযাপন করার কথা ছিল তাদের আর আমাদের মাঝে থাকা হলো না। কেউ হারিয়েছে পাহাড় ধসে , কেউ রাস্তায় চলমান গাড়ির ধাক্কায় আবার ভয়ঙ্কর আগুনে পুড়ে। তারা চলে গেছে না ফেরার দেশে যাদের আর আমরা কাছে পাবনা।জানিনা স্বজন হারা মানুষের আহাজারির সান্তনা কি? শুধু জানি নিরব অশ্রু বিসর্জন ছাড়া কিছুই নেই। ফিরবে না জেনেও অপেক্ষা করা, যদি কখনো ফিরে আসে।
চট্টগ্রাম আমার জন্মস্থান। আমার পৈত্রিক বাডিও চট্টগ্রাম অর্থাৎ পুরোপুরি চাটগাঁর মেয়ে আমি। চট্টগ্রামের আচার অনুষ্ঠান, অতিথি আপ্যায়ন, সামাজিকতা দেশ সেরা। এটা নিয়ে গর্ব করা যায়। চট্টগ্রামের বিয়ে মানে অতিথিদের মিলন মেলা, এমনও হয় বছরে একবারও যাদের সাথে দেখা মিলে না বিয়ে সাদিতে তাদের দেখা পাওয়া যায় অর্থাৎ বিয়ে মানে হৈহৈ রৈ রৈ কারবার। পারিবারিক সম্মতিতে যে বিয়ের আয়োজন করা হয় তা তো এক বিরাট কাহিনী অবতরণ করে, প্রথমে কনে দেখা এরপর মুরব্বি দের বৈঠক, সেখানে আলোচনা চলে জিনিস পত্রের আদান প্রদান ,বরযাত্রীর পরিমান, গহনা শাড়ি কাপড়ের হিসেব। বলা যায়, এক অর্থে ব্যবসায়িক আলোচনা। দৃষ্টিপাত নাই কারো কার কতটুকু সামর্থ, বিশেষ করে মেয়ের বাবার উপর চলে যত ধরনের আবদার।
মেয়ের বাবার শুধু তার আদরের মেয়ের বিদায়ের বিরহে কাতর থাকেন না পুরো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা, সামাজিকতা, আত্মীয়স্বজন, খাওয়া-দাওয়া, বরের উপহার সব কিছুর দায়িত্ব থাকে কন্যা দায়গ্রস্ত পিতার ওপর, তাও আবার বর পক্ষের পছন্দ মাফিক। শুধু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় শেষ নয় সারাবছর চলে এই লেনদেন, গ্রীষ্মকালীন ফল থেকে শুরু করে সারা বছর যত রকমের নিয়ম আছে তা পালন করা, তা না হলে মেয়ের মুখ ছোট হয়ে থাকবে , শুনতে হবে নানা খোঁচা। প্রতিটি ক্ষেত্রে আগ্ঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হবে মেয়েটির অপরাগতা। কতটা অসহায় থাকে বধূ হয়ে আসা মেয়েটি। ছোটবেলা থেকে বউ সাজার স্বপ্ন গুলো যেনো আস্তে আস্তে নিভে যায়, অনেকের ক্ষেত্রে নেমে আসে নির্মম অত্যাচার, কারো চলে যায় প্রাণ কিংবা এসিডে ঝলসে যায় মুখ আবার কারো শরীর আগুনে ঝলসে যায়। এই ধরণের ঘটনাগুলোর সাথে আমরা কম বেশি পরিচিত , যেহেতু এগুলো প্রকাশিত কারন এখানে নির্যাতনের মাত্রা শেষ পর্যায়ে কিন্তু কিছু আছে মানসিক নির্যাতন যা চোখে দেখা যায় না প্রতিনিয়ত অনুভব করা যায়, মানসিক নির্যাতন। এ ধরণের নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশের পচাঁনব্বই ভাগ মহিলা আমি আমার এক আত্মীয়ের বিয়ের পর দেখেছিলাম বর পক্ষের বায়না, যেনো ছেলে বিয়ে করিয়েছে লটারি লাগার জন্য।
আমার আত্মীয় ভালই অর্থ সম্পদের মালিক ছিল বলে মোটামুটি তাদের আবদার পূরণ করতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু আরো চায় মানুষ গুলোর চাওয়ার যেনো শেষ নেই।এক রোযার ঈদের রান্না করা ইফতার পাঠিয়েছেন মেয়ের শশুর বাড়িতে, কিন্তু মেয়ের শশুরমশাই খুশি হননি কারন পরিমাণ আরো লাগবে যাতে পাডাতে বিলাতে পারে , মেয়ের বাবা কম যান না তিনিও ট্রাক ভর্তি করে কাঁচা ইফতারি পাঠালেন, বরের খুশি কে দেখে, বন্ধুদের কাছে বাজিমাত, এরপর এলো কুরবানি। হা এখানেও আছে কুরবানির বলিদান। মেয়ের শশুরবাডিতে পাঠাতে হবে গরু , তাও যেনো তেনো গরু না সমাজে যেনো সম্মান থাকে। মেয়ের বাবা কুরবানি দিতে পারুক আর না পারুক মেয়ের শশুরবাডিতে পাঠাতে হবে এটা বাধ্যগত। যেনো মেয়েটাকে বধূ বানানোর কঠিন শাস্তি
মেয়ের বাবা মানে ছোট হয়ে থাকা।এই নিয়ম কাদের তৈরি? কেনইবা তা পূরণ করতে হবে? সবচেয়ে করুন অবস্হা হয়েছিল আমার এক প্রতিবেশির। সল্প আয়ের মানুষ ছিলেন তিনি। মেয়েকে পড়া লেখা করিয়ে ছিলেন , ভালো পরিবারে বিয়ে দিলেন , বিয়ের সময় বর পক্ষের কোনো দাবি দাওয়া ছিল না কিন্তু বিয়ের পর সুর পরিবর্তন, আস্তে আস্তে চাওয়া শুরু হয়। মেয়ের বাবা তার সাধ্যমত চেষ্টা করেছে তবুও বরের চাহিদা পূরণ করতে পারেননি ,পারেন নি কুরবানিতে বড় গরু উপহার পাঠাতে তাই আজও বিশ বছর সংসারে তিনশ পঁয়ষট্টি দিনে প্রায় প্রতিদিনই শুনতে হয় খোঁচা। এ যেনো নিরব সুঁই ফোটানোর ব্যথা। রক্ত ঝরে কম কিন্তু হ্রদয়ের ক্ষরণ করে প্রতিনিয়ত। এটা শুধু একটা দুইটা পরিবারের ঘটনা তা কিন্তু না , এটা বেশিরভাগ মেয়ের চিত্র। মেয়েরা পারছেনা এটা থেকে নিস্তার, ওরা জিম্মি হয়ে আছে এদের কাছে। সংসার , সমাজ, সন্তান যেনো, বধূ সেজে থাকা মেয়েটির চারপাশে অদৃশ্য বন্ধন তৈরি করে রাখে যা থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।ইচ্ছে করলে পারে না মুক্ত হতে। আমাদের দেশে স্বামী ছাড়া মেয়েদের স্বামী পরিত্যক্ত বলে, স্বামী পরিত্যক্ত নারী সমাজের ময়লা হিসাবে গন্য করা হয় , কারণ এ ক্ষেত্রে শতভাগ দোষ মেয়েদের উপর অর্পণ করা হয় অর্থাৎ তুমি দোষী নারী তা না স্বামীর ঘর করতে পারনি কেনো? সব চেয়ে কমন কথা থাকে মেয়েদের আত্মত্যাগ করতে হয়, সহ্য ক্ষমতা থ্কতে হয় তাহলে সে মেয়ে সাংসারিক। অর্থাৎ মেয়েদের সব রকম নির্যাতন সহ্য করতে হবে।
মজার ব্যপার হলো- আমরা প্রযুক্তি ব্যবহারে যত উন্নত হচ্ছি তত বেশি এর অপরাধ প্রবনতায় ভুগছি তার উদাহরণ দৌলতপুর গ্রামের এক পরিবারের। বিয়ের আগে বর পক্ষের দাবি ছিল বরের জন্য স্বর্নের চেইন দিতে হবে, মেয়ের বাবাও বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছিল যখন বিয়ের পর মেয়ের বাবা চেইন দিতে ব্যর্থ হন তখনি বর মেয়ের আপত্তিকর ছবি তুলে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়। শুধু মাত্র একটা চেইনের জন্য মানুষ কতটা লোভী আর নীচ হলে এতোটা নোংরামি করতে পারে। আরো কুৎসিত ঘটনা হলো এক পাষন্ড স্বামী পর্যাপ্ত পরিমান যৌতুক পায়নি বলে তার স্ত্রীকে বন্ধুদের দ্বারা ধর্ষণ করিয়েছে। এ সমস্ত ঘটনা একটা দুইটা না হাজার হাজার এই রকম ঘটনা আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটছে। আমরা সবাই এই সমস্ত ঘটনা গুলো জানি। অথচ এই ব্যপারে রাষ্ট্রীয় আইন, ধর্মীয় আইন চুপ। আমাদের দেশে ধর্মকে এক শ্রেনির মানুষরা নিজেদের প্রয়োজনের জন্য ব্যবহার করে, সত্যিকার অর্থে ধর্মের প্রয়োগ থাকলে এতো অপরাধ জন্ম হতো না।
বিয়ে মানে ভালবাসার ধর্মীয় বৈধতা। সব ধর্মে বিয়ের কথা বলা হয়েছে। বিয়ের মাধ্যমে দুটি প্রাণের মিলন ঘটে। সারাজীবনের সুখ দ:খের সাথী হলো স্বামী স্ত্রী, এই নিয়ম বিধাতার তৈরি করে দিয়েছেন যাতে আমাদের জীবনটা সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারি। একটু সুন্দর ভালো ব্যবহার একটা সুন্দর স্মৃতি তৈরি করতে পারে যা আমাদের ছোট জীবনটাকে আরো আনন্দময় করতে পারে, প্রয়োজন শুধু লোভহীন সুস্থ, সুন্দর মন আর অকৃত্রিম ভালোবাসা।
আমরা কি পারিনা যৌতুক প্রথা থেকে বেরিয়ে আস্তে। যৌতুক সামাজিক ব্যাধি, এ ব্যাধি থেকে রক্ষা পেতে সবার আগে ধনীদের এগিয়ে আসতে হবে লোক দেখানো লোকীকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, কারণ টাকার আভিজাত্য কারও জন্য মরণ ফাঁদ।