ভাবতে কষ্ঠ হয়- বাবা নেই

911 Visited

22 Sep
ভাবতে কষ্ঠ হয়- বাবা নেই

লন্ডন থেকে শেখ মহিতুর রহমান বাবলু ::     

দেখতে দেখতে অতিবাহিত হলো অনেক দিন। বাবা নেই। কথাটা ভাবতেই বুকটা ব্যথায় টন টন করে ওঠে। মনের ব্যাকুলতা স্থির হয়ে যায়। শ্বাস প্রস্বাস বন্ধ হয়ে আসে। থেমে যেতে চায় রক্ত সঞ্চালন। আমার পাজর ভেঙ্গে যেন বেরিয়ে আসতে চায় হৃদপিন্ডের সব রক্ত। কারন- আমার বাবা, 
 মা, আমার মাতৃভূমি, আমার অস্তিত্বের মানচিত্র।

৫ মার্চ রোববার। যথারীতি কাক ডাকা ভোরে কাজে গিয়েছি। মুঠো ফোন বেজে উঠল। খুলনা থেকে আমার বন্ধু হুমায়ুন কবিরের ফোন। আমার অফিসের চারপাশ সিসি ক্যামেরা দিয়ে ঠাসা। কাজের সময় ব্যক্তিগত মোবাইল ব্যবহার করার নিয়ম নেই। এদিকে হুমায়ুন কল করছে বার বার। ফোনটা সাইলেন্ট করে রাখলাম।কাজ শেষ, এবার খবরের কাগজ ও কফি নিয়ে ক্যান্টিনে বসেছি। মনে পড়লো ফোনটাতো সাইলেন্ট, ফোন ওপেন করতেই আমার শরীরের সব রক্ত হীম হয়ে গেল। চোখে পড়ল অগনিত কল ও ম্যাসেজ। কেউ শোকবার্তা জানিয়েছেন, কেউ নিশ্চিত করেছেন বাবার মৃত্যুর খবর। ভেতরটা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। হৃদপিন্ড থেকে কন্ঠনালী পর্যন্ত থরে থরে সাজানো আমার পাথুরে মনের বাঁধ উপচে কান্নার ঢেউ আছড়ে পড়তে  লাগল। 

নিজেকে কোনরকম সামলে নিয়ে অফিসের কারো সাথে কোন কথা না বলে সরাসরি বাসায় চলে এলাম। বাসার ভেতর তখন চলছে নীরব কান্নার আহাজারি। আমাকে দেখে সবাই নীরব। কেউ কিছু বলছে না। তারা শুধু লক্ষ্য করছে আমার গতিবিধি।

আমার বাবা তার ছেলে বউ দেরকে ভিষন স্নেহ  করতেন। আপন করে নিয়েছিলেন নিজের মেয়ের মতো করে। ছেলে বউদের সাথে আনন্দ, ফুর্তি, হালকা রসিকতা ও সবাই মিলে পান খাওয়া ছিল তার নিত্য দিনের সংগী। আমার গিন্নি দেশের বাইরে থাকে, এক্ষেত্রে তার জন্য ছিল বাবার আলাদা দরদ। দেশে গেলে গিন্নি থাকতো আমাদের নিরালার বাসায়। বাবা থাকতেন সোনাডাঙ্গা। গ্রামের বাড়ী থেকে বড় মাছ, আম, কাঠাল, খেজুর বা তালের রস, চিংড়ি মাছ, ফল-মূল এলে বাবা কাউকে ছুতে পর্যন্ত দিতেন না। বলতেন মেঝ বউ বিদেশে থাকে, ওখানে এসব পায় না, তাকে ডাকো ,তোমরা কোন কিছুতে হাত দিও না। পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহনের সময়ও ঐ মেঝ বউ। দেশে না থাকলে টেলিফোনে জরুরী আলাপ সেরে নিতেন মেঝ বউ মার সাথে। 

কয়েক বছর আগে হঠাৎ করেই চলে গেলেন আমার শশুর। এর পর থেকে আমার গিন্নির বাবা বলে ডাকার শেষ সম্বল হয়ে ওঠেন শশুর বাবা। আজ তিনিও চলে গেলেন। তাই সে বাকরুদ্ধ, চোখে মুখে শুধু বিষাদের আল্পনা। আর্তনাদ ও বিলাপে বাসার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। দুঃচোখ তার রক্তজবার মত রাঙা, ফুলে ফেপে উঠেছে সমস্ত মুখমন্ডল ।

বাসায় ফিরে কল করলাম খুলনায়। কথা হল ছোট ভাইয়ের সাথে। ততোক্ষনে সবশেষ। বাবা এ পৃথিবীর সব মায়ার বাধন ছিন্ন করে শায়িত হয়েছেন অন্ধকার কবরে। যেখানে স্ত্রী, সন্তান, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব আপনজন- কেউ নেই। তিনি একেবারেই একা। পরিবারের রীতি অনুযায়ী মৃত্যুর কয়েক ঘন্টার মধ্যে বাবার ইচ্ছামতো পারিবারিক কবরস্থানে দাফন না করে তাকে খুলনা বসুপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

 

প্রযুক্তির এই স্বর্ণযুগে বাবা অন্ধকার কবরে শায়িত হবার আগে তার মৃত্যুর খবরটুকু জানার সৌভাগ্য আমার হল না। এরই নাম প্রবাস। এই নশ্বর পৃথিবীতে প্রবাস ও পরবাস এ দুটি শব্দ কঠিন বাস্তবতার সামনে এভাবেই মিলিত হয় একই মোহনায়।  

 সন্ধার পর ছেলে মেয়ে দুটোকে প্রিয়ার মতো বুকে জড়িয়ে  শুয়ে আছি। অবিরাম চোখের জলে বালিশ ভিজে একাকার। এমন সময় বাসায় সান্তনার বানী নিয়ে ছুটে এলেন চ্যানেল আই ইউরোপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক- রেজা আহম্মেদ ফয়সাল চোধুরী, বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজ উদ্দীনের প্রেস সেক্রেটারী- সামসুল আলম লিটন সহ কম্যুনিটির বিশিষ্টজনেরা। টেলিফোন ও ম্যাসেজ দিয়েও সমবেদনা জানালেন অনেকেই। এদের সবার কৃতজ্ঞতার পাশে আমি আবদ্ধ।

অনেকদিন পর  বছর দুই আগে দেশে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় বাবা কাছে ডেকে বসালেন। মাথায় ও শরীরে হাত বুলিয়ে বললেন,- “এ জনমে তোমার সাথে আর বোধ হয় দেখা হবে না”। আমার দুহাত চেপে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে ফেললেন আর বললেন “বাবা হিসাবে আমি কখনো দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিলে আল্লাহ্র ওয়াস্তে ক্ষমা করে দিও”। আমার দুচোখ জলে ভিজে গেল, আবেগ জড়ানো কন্ঠে বলেছিলাম, এভাবে বলতে নেই বাবা। বয়স অনুপাতে আপনিতো অনেক ভাল আছেন। তাছাড়া বিধাতা কাকে কখন ডাকবেন এ প্রশ্নের জবাব তিনিই ভাল জানেন। 
বাবা আমার কথায় কর্ণপাত না করে আবার বললেন,- “আমার অবর্তমানে পরিবারের সম্পত্তি শরিয়াতের বিধান মতে ওয়ারেশদের মাঝে সুষম বন্টনের দায়িত্ব তোমার উপর রইল”। আমি এবার বললাম, বাবা এ বিষয়টি আপনি পূনরায় বিবেচনা করবেন কিনা, ভেবে দেখার দরখাস্ত রইল। কারন গুরুজন হিসাবে আমার সামনে আছেন মা, বড় ভাই ও বড় বোন। বাবা এবার আমার চোখে চোখ রেখে বললেন- “দিস ইজ নট মাই রিকোয়েস্ট। দিস ইজ মাই ওয়ার্ডার”।

আমি ডাক্তার পরিবারের সন্তান। ছাত্র জীবনে বাবাকে তার চেম্বারে সহযোগিতা করেছি। প্রবাসে আসার আগে দেশের স্বনামধন্য ঔষধ কোম্পানীর ফিল্ড অফিসার ছিলাম। এ জীবনে অনেক ডাক্তার, রোগি, হাসপাতাল ও মরা মানুষ দেখেছি। চোখের সামনে হারিয়েছি অনেক আপনজন। কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষ হারানো আর নিজের বাবা হারানোর পার্থক্য তিলে তিলে টের পাচ্ছি। সব সময় মনে হয় দেশে গেলে বাবা আর একটি বারও আমার নাম ধরে ডাকবেন না।

আমার জনমদুঃখি মা বেঁচে আছেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনি বার বার জিজ্ঞাসা করেন, “কবে দেশে আসবি বাবা”? মায়ের কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমি যন্ত্রদানব ইউরোপের পথে পথে স্মৃতি হাতড়ে বেড়াই। স্মৃতি হচ্ছে বন্ধন আর বিস্মৃতি হচ্ছে মুক্তি। আমি মুক্তি পেতে চাই না। স্মৃতি অফুরন্ত, অমলিন, অবিনশ্বর। চারিপাশে সর্বক্ষন ঘুরছে আর ঘুরছে। আর আমি  সবখানে খুজে বেড়াচ্ছি - বাবা হারানোর ঠাই।

 

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক, লেখক ও কলামিষ্ট