শেখ মহিতুর রহমান বাবলু : আগেতো জমিদার বাড়ির ত্রিসীমানায় মুসলমান ও নিচু জাতের হিন্দুদের যাওয়া আসা সংরক্ষিত ছিল। মুসলমানরা তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে জুতা পায়ে এবং ছাতা মাথায় দিয়ে যেতে পারতো না। এ কারণে সাধারণ মানুষের সাথে ওঠা বসার সুযোগ ছিল না কবিগুরুর । স্কুলেও যেতেন না। গৃহ শিক্ষকের কাছে বাসায় পড়তেন। তার সীমানা ও গন্ডি ছিল সীমিত । কারণ তিনি তো সাধারণ পরিবারের কেউ নন। জোরাসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির জমিদারের ছেলে রবীন্দ্রনাথ।
ছোটবেলায় রবি ঠাকুরের বিভিন্ন বই পড়ে বিস্মিত হয়েছি। জমিদার পরিবারে বেড়ে ওঠা এই মানুষটি কী করে এতকিছু জানেন ? আর কিভাবেই ফুঁটিয়ে তোলেন তার লেখনীতে !
সে বিস্ময় থেকে জানতে চাওয়া আজ অব্দি তাড়িত করে আমাকে। আমি জানি এই ছোট্ট জীবনে একজন রবীন্দ্রনা্থকে জানতে চাওয়ার কোন যোগ্যতা আমার নেই। তবুও কবিগুরুকে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে শান্তিনিকেতন যাবার মনস্থ করলাম।
বিশ্বখ্যাত মার্কিন ফুড সাপ্লিমেন্ট কোম্পানি ফরেভার এ কর্মরত আমার এক সহকর্মীর সাথে দেখা মিললো কলকাতায়। তারা সপরিবারে আমার সাথে যেতে চাইলেন ।
হাওড়া থেকে গণদেবতা, শান্তিনিকেতন, ইন্টারসিটিসহ বেশকিছু ট্রেন যায় বোলপুর।দূরত্ব ১৬৩ কিঃ মিঃ। বোলপুর স্টেশন থেকে শান্তিনিকেতনের দূরত্ব প্রায় ৩ কিঃমিঃ ।আমরা গণদেবতায় চেপে বসলাম। আমার সফরসংগী সীমা সেন ,তার মেয়ে রিপা দাস ,নাতনি অংকিতা দাস ও অর্পিতা তরী । এ ছাড়া শিমা সেনের ভাই বউ বন্দনা সেন এবং তার দুই ছেলে মেয়ে রূপম সেন ও রিয়া সেন।
ট্রেনের জানলা দিয়ে দুই ধারের গ্রাম্য শোভা দেখতে দেখতে চলেছি। লালমাটির উপর সবুজের শোভা সত্যি মনকাড়া।প্রকৃতি আমাদের হৃদয়কে উদ্দীপ্ত করে তোলে। অনুপ্রাণিত করে কল্পনা শক্তিকে। সেই প্রকৃতি দেখার জন্য আমরা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছুটে চলি।
তরী আমার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আঙ্কেল বলে ডাকদিল।চোখ দিয়ে ইশারা করল পিছনে । মধুর কণ্ঠে কানে ভেসে এলো ” ইসছে পহেলে কে তু মুঝে ছোড়ে ,মুজছে টুকরা এ মেরা দিল তোড়ে ,আপনা দিল খুদ মেয় তোড় যাউংগা , মেয় তেরে শহর ছোড়ে যাউংগা ………..”
কিশোর কুমারের গান। সম্ভবত নাজরানা ছবিতে রাজেশ খান্না অভিনীত এক সময়ের জনপ্রিয় গান। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ভাবতে কষ্ট হলো কিশোর কুমার নয় বরং এক অন্ধ বালকের কণ্ঠ থেকে বের হচ্ছে এমন মধুর আওয়াজ।
ট্রেনের বগিতে হেটে হেটে অন্ধ ভিক্ষুক হ্যান্ড মাইক দিয়ে গাইছে এ গান। অনেকে দুই চার পয়সা দিয়া সাহায্য করছে তাকে। সত্যি অপূর্ব কণ্ঠ। সচ্ছল ঘরে জন্ম নিলে প্রতিষ্টিত শিল্পী হতো ,সন্দেহ নেই।গোটা পথ জুড়ে এমন অনেকের দেখা মিললো।
আমাদের উপমহাদেশে সুযোগের অভাবে এমন কত প্রতিভা হারিয়ে গেছে কে তার খবর রাখে। ইউরোপ আমেরিকাতে এমনটি হবার উপায় নেই।সেখানে প্রতিটা শিশু যথাসময়ে প্রাথমিক স্কুলে যেতে বাধ্য। এটা সরকারি আইন।সময় হবার আগেই পৌরসভা থেকে চিঠি দিয়ে টেলিফোন করে মনে করিয়ে দেয়া হয়। স্কুলে না পাঠালে বাবা মাকে জরিমানা সহ জেল জুলুম পর্যন্ত সহ্য করতে হয়।তাতেও কাজ না হলে শিশুকে কেড়ে নেয়া হয় পরিবার থেকে।স্কুলে যাবার পর পড়াশুনার পাশাপাশি প্রতিটা ছেলে মেয়েকে খেলা ধুলা গান বাজনা সহ না না বিষয়ে নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেয়া হয়।এটাও বাধ্যতামূলক।কোন বিষয়ে প্রতিভাবান মনে হলে তাকে পাঠানো হয় বিশেষজ্ঞর কাছে । যার যেখানে প্রতিভা আছে ওটাকে টেনে বের করে ক্যারিয়ার গঠনের দায়িত্ব নেয় খোদ সরকার। সুতরাং এসব দেশে কোন বিরল প্রতিভা হারিয়ে যাবার সুযোগ নেই।যা আমাদের অঞ্চলে আজও বিদ্যমান ।
প্রাচীন কাল থেকে হিন্দু মহিলারা স্বামীর জন্য সিঁথিতে সিঁদুর পরেন ।এ ধর্মে বলা হয় সিঁদুরের লাল রঙ স্বামীর দীর্ঘ জীবন কামনা করে ।সিঁদুর বিবাহিত মহিলার প্রতীক। যা তারা স্বামীর মঙ্গলকামনায় ব্যবহার করে । হিন্দু ধর্মে মনে করা হয়, স্ত্রী তার সিঁদুরের শক্তিতে স্বামীকে যেকোনো বিপদ থেকে বাঁচাতে পারেন । দেবী লক্ষ্মীর কৃপায় স্বামী ও স্ত্রী একসাথে সুখে থাকেন । সম্পর্কে কোন সমস্যা আসে না।
পৃথিবীর অন্য দেশের মত কোলকাতেও সংসারের সব দায় ভার পরিবারের কর্তা পুরুষের কাঁধে।যদিও সেখানে মহিলাদের একটা বিরাট অংশ কিছু না কিছু করেন। হিন্দু ধর্মের অনুসারী মহিলারা মনে করেন স্বামী হচ্ছে দেবতা। মন্দির হল শশুর বাড়ি। স্বামী আশ্রয় দাতা। তার সম্মান সবার উপরে।
অবাক হলাম শিব দেবতা তুল্য সেই পুরুষের সাথে রাস্তা ঘটে মহিলাদের আচরণ দেখে। কোন পুরুষ মানুষ যখন ভুল ক্রমে মহিলা বাসে , ট্রেনের মহিলা বগিতে অথবা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়েন তখন মহিলারা সবাই মিলে এই আশ্রয়দাতা মানুষটিকে শুধু অপমান অপদস্থ নয় , মেরে ধরে জামা কাপড় পর্যন্ত ছিড়ে একাকার করে দেন।একবারও ভাবেন না এই মানুষটি কোন না কোন পরিবারের আশ্রয়দাতা। সে তো মানুষ। ভুল হতেই পারে।অথচ যখন কোন মহিলা, পুরুষের বগিতে ওঠে তাকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেন পুরুষ।
সোজা সাপটা ভাবে বলাই যায় পৃথিবীর অন্য সমাজের থেকে ভারতীয়রা এক্ষেত্রে পৃথক। এদেশে ধর্মীয় পরিচয় যেমন একশ্রেণির মানুষকে দলিত করেছে। তেমনি পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্যে, তৈরি হয়েছে সহিংসতা ।এ যেন তীব্র প্রতিহিংসা আর প্রতিযোগিতার জটিল এক কূটনৈতিক সম্পর্ক।
কলকাতা বিমানবন্দরে আমিও এমন রোষানলের শিকার হয়েছিলাম।শ্রীলঙ্কা থেকে ফেরার পথে ভুলে মহিলা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ি। অমনি চিৎকার এবং দরজায় এক যোগে কিল ঘুসি ও লাথির আওয়াজ শুনতে পাই। ভাবলাম আগুন লেগেছে বুঝি। কাজ শেষ না করেই বেরিয়ে এলাম। পরিছন্ন কর্মী সহ এক ঝাঁক মহিলা আমার দিকে তেড়ে এলো।মনে হল ভিমরুলের চাকে টোকা দিয়েছি আমি। অপমানে ভয়ে আমার শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। তারা বলছে “এটা মহিলাদের ওয়াশরুম চোখে দেখেননা মশাই। এক্ষুনি বেরিয়ে যান। নইলে … .”
আমার লাল পাসপোর্ট দেখিয়ে বলতে চাইলাম মাফ করবেন। ভুল হয়েছে। সাইনটা অপরিষ্কার। আমি বিদেশী বুজতে পারিনি।
মুখ খুলতেই তারা বললো “আগে বের হন তার পর কথা”।
জীবন বাঁচানোর খাতিরে কোন কথা না বলে সুর সুর করে বেরিয়ে এলাম। কি ভয়াবহ পরিস্থিতি রে বাবা।মান ইজ্জতের মামলা। মনে হলো কলকাতার মহিলাদের উপর আমি বুঝি এটম বোমা নিক্ষেপ করার মত অপরাধ করেছি।
কেউ কেউ বলেন শিক্ষিত সমাজে এসব কম। কেউ বলেন নিম্নবিত্তের জীবনে এর পরিমাণ বেশি। ঘটনা তেমন নয়। ভারতের প্রায় সব গোষ্ঠী এবং সব সমাজেই এই কু-প্রথা আছে। নিম্নবিত্তের ক্ষেত্রে সমস্যা অন্যরকম। সমাজে নারী অধিকারের অন্ধকারে সে এক বিভীষিকা। আর উচ্চবিত্ত রক্ষণশীল সমাজে চেহারাটা পর্দার আড়ালে একই রকম। যেন ফাঁসির দড়িতে বিলেতি মোম লাগানো। রেশমের ডোর দিয়ে শ্বাস রোধ করা।ইত্যাদি
রিপা বৌদিকে এ ঘটনা বলতেই লজ্জায় ফুটা বেলুনের মতো চুপসে গেল।প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে অন্য কথায় গেলেন তিনি।আমিও আর কথা বাড়ালাম না
দেশজুড়ে পর্যটনের তালিকায় বহুদিন আগেই পাকাপাকি ঠাঁই করে নিয়েছে শান্তিনিকেতন। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পালিয়ে আসা ও গৃহশিক্ষকদের দ্বারা শিক্ষিত রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন প্রথম আসেন যখন তার বয়স ১২ বছর ।১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে স্থায়ীভাবে তিনি শান্তিনিকেতনে চলে আসেন।পরবর্তীতে সেখানে তিনি এমন এক বিদ্যালয় গড়ে তুললেন যেখানে শিশুদের তাঁর মত শোচনীয় শিক্ষাপ্রণালীর যন্ত্রণা ভোগ করতে না হয় ।
রুক্ষ লাল মাটি ও সবুজ ঘনবনের মেলবন্ধনেই বীরভূম জেলার বোলপুরের অলংকার আজকের শান্তিনিকেতন।শান্তিনিকেতনের প্রকৃত নাম ভুবনডাঙা। রবীন্দ্র পাঠক ছাড়া অনেকের ধারনা-রবীন্দ্রনাথই শান্তি নিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা।একথা সঠিক নয়। সত্য যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরই শান্তি নিকেতনের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা।
১৮৬৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নি:শব্দ-শান্ত পরিবেশকে খুব পছন্দ করতেন। তাই তিনি ধ্যান ও আধ্যাত্মিক চিন্তার জন্য মাঝে মধ্যে কোলকাতা থেকে অনেক দূরে হিমালয়ের নির্জনতায় চলে যেতেন। ১৮৬২ সালে তিনি একবার বোলপুর থেকে রায়পুর যাবার পথে এক দীর্ঘ নির্জন এলাকা দেখতে পেলেন। লক্ষ্য করলেন চারিদিকে ধূ ধূ মাঠ আর খোয়াই। মাঝে চোখে পড়লো শুধু দু’টি ছাতিম গাছ। শান্ত ছায়া সুনিবিড় কোলাহলমুক্ত নির্জন স্থানের সেই গাছের ছায়ায় তিনি সেদিন কিছুক্ষণ বিশ্রাম এবং ঠাকুরের উপাসনা করে খুবই তৃপ্তি পান।
১৮৬৩ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের জমিদার ভুবনমোহন সিংহের কাছ থেকে ছাতিম গাছ দু’টিসহ ২০ বিঘা জমি নেন। একই বছর তিনি এখানে একটি অতিথিশালা স্থাপন করে তার নাম দিলেন ‘শান্তি নিকেতন’। কালক্রমে পুরো জায়গাটিরই নাম হয়ে গেল আজকের শান্তি নিকেতন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০ বিঘা জমি কিনলেও রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বা শান্তি নিকেতনের আয়তন বর্তমানে ১২০২.৩১ একর।
বোলপুর ছোট্ট ট্রেন স্টেশন। জরাজীর্ণ কক্ষ, নেই কোন মানসম্মত বসবার ব্যবস্থা। দেয়ালের ফাটল দিয়ে উকি দিচ্ছে পরগাছা। স্টেশন থেকে আমাদের সাথে বেরিয়ে এল নানা বয়সী লোকজন, দেশি-বিদেশি পর্যটক। রিকশা বা মোটরগাড়িতে শান্তিনিকেতন যাওয়া যায়। আমরা সারাদিনের জন্য একটা মাইক্রো বাস নিয়ে নিলাম। শিমা দেবী নিরামিষ ভোজী । আমিষ ভোজীদের হাতের কোন কিছু তিনি গ্রহণ করেন না। তাকে নিয়ে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। ভ্রমণের সময় তিনি ডাব খান। আমরাও এ মওকা হাতছাড়া করিনি ।সবাই মিলে ডাব খেয়ে হুড়মুড় করে মাইক্রোতে উঠে বসলাম । ( চলবে )
লেখক : টিভি উপস্থাপক ,প্রবাসী সাংবাদিক কলামিস্ট, লেখক