লন্ডনের বুকে এক ফালি খুলনা // রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধীতা নয়, দাবী বাঁচাও সুন্দরবন....

546 Visited

22 Sep
লন্ডনের বুকে এক ফালি খুলনা // রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধীতা নয়, দাবী বাঁচাও সুন্দরবন....

লন্ডন থেকে এ্র্যাডভোকেট ইফফাত আরা ::  বিকাল ৫টা। হলের সার্বিক পরিস্হিতি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছেন এ্যাডভোকেট মোঃ মহিব্বুল্লাহ সাথে সৈয়দ ইমরুল হাসান, এ্যাডভোকেট জি এম আমিনুর রহমান, আইনজীবি ডলার বিশ্বাস  এবং ফয়সাল জামিল।  জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক  সাংবাদিক শেখ মহিতুর রহমান  বাবলুকে একটু বিরক্ত মনে হচ্ছে। হলের লাইটিং ব্যবস্থা দেখে তিনি খুশী নন। এ ব্যাপারে কথা বললেন হল কতৃপক্ষ ও আয়োজকদের  সাথে।

ব্যানার কোথায়? ব্যানার কোথায়  ? হাকডাকের মাঝে কে যেন বলে উঠল ব্যানার নিয়ে এখনো পৌছায়নি এ এস এম শিপার ভাই। সাথে সাথে একাধিক টেলিফোন ঝাপিয়ে পড়লো শিপার ভাইয়ের মোবাইলের উপর। এরই মধ্যে হলে এসে পৌছালেন ডাঃ মিজানুর রহমান। হলের এক কোনায় বসে সমানে বেলুন ফুলিয়ে চলেছেন মাহিমা খাতুন রিমু। সামনে যাকে পাচ্ছেন তাকেই বেলুন ধরিয়ে দিচ্ছেন তিনি। বলছেন অনেক বেলুনের দরকার , অলস সময় না কাটিয়ে বেলুন ফুলান। বেলুন ফুলানোর পদ্ধতিও বননা করছেন রিমু। বেলুনটা টেনে একটু লম্বা করুন। তারপর তিন ফু। ব্যাস হয়ে যাবে আস্ত একটা বেলুন।

এস এম শিপার ভাই ব্যানার নিয়ে আসলেন।অতিথিদের অনেকেই ফোন করছেন লোকেশনের খোজে । রোববার যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বৃহত্তর খুলনার (খুলনা বিভাগ) ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান শুরুর আগ মুহূর্তের দৃশ্য ছিল এমনই।

বিকাল ৬টা। অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন। হলে প্রবেশ করলেন অধ্যাপিকা কামরুন্নাহার লিপি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি।কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে ফেলোশিপ করছেন লন্ডনের এসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাথে রয়েছেন জীবনসংগী কাজী জাবের এবং ছেলে এমিরা জাবের।দেখতে দেখতে লোকে লোকারন্য । চারিদিকে হৈ হৈ কান্ড আর রৈ রৈ ব্যাপার। সোনার গা হোটেলের হলরুম পরিনত হলো লন্ডনের বুকে মিনি খুলনায়। আয়োজকদের চোখে মুখে উদ্বিগ্নতা। এত মানুষের জায়গা সংকুলান হবে তো?

এ্যাডভোকেট মোঃ মহিব্বুল্লাহ অন্য আয়োজকদের সাথে একটু ফিস ফিস করলেন। হলের শব্দযন্ত্র পরীক্ষা করা হলো। সাংবাদিক মহিতুর রহমান বাবলু তার ক্যামেরা নিয়ে রেডী। এন টিভি ইতালীর বোলছানো  সাবেক  প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম সিকদার,চ্যানেল আই ইউরোপের প্রতিনিধি শাহ এমি ,এন টিভি ইউরোপের প্রতিনিধি শুভন ভাই  সহ অনেক সাংবাদিক ইতিমধ্যে এসে গেছেন। এস এ টিভি ইউকের ব্যুরো প্রধান হেফাজুল করিম রাকিব টেলিফোনে জানালেন অল্পক্ষনের মধ্যেই তিনি পৌছে যাবেন।এদিকে ভাবীরা জুড়ে দিয়েছে রসালো আলাপ। কেউ কেউ বাচ্চাদের সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে। কেউবা আবার সেলফি, সাজগোজ,ফেসবুকে পোষ্ট ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত।

রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ ... ... বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জগৎ বিখ্যাত এই গানটি দিয়ে শুরু হলো ঈদ পূনর্মিলনী অনুষ্ঠান।

প্রখ্যাত আইনজীবি ব্যারেষ্টার সৈয়দ ইমরুল হাসান উদ্বোধনী বক্তব্য দিলেন। “আমরা খুলনা বিভাগবাসী” ব্যানারে আয়োজিত ঈদ পূনর্মিলনী অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করলেন তিনি। রাজনৈতিক আলোচনা না করতে কঠোরভাবে অনুরোধ করলেন সকলকে।

চমৎকার ভাষ্কয ও পেইন্টিংয়ে সজ্জিত মঞ্চে সভাপতির আসন কেউ অলংকৃত করলেন না। আজ সবাই রাজা। ঘোষনা মঞ্চ থেকে আগ্রহী সকলকে ঈদ ভাবনা ও প্রবাসে ঈদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে আহবান করা হলো।

এদিকে আয়োজকদের সবাই সাইড লাইনে সারিবদ্ধভাবে দশকের মতো বসে রইলেন।

আলোচনার এক পর্যায়ে সবার সম্মতিক্রমে ঢাকার গুলশানের আর্টিসান ব্যাকারী ও কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ববরোচিত সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাযগ্যের উপর তীব্র নিন্দা ও শোক প্রস্তাব গৃহীত হলো। এ্যাডভোকেট মোঃ মহিব্বুল্লাহর নেতৃত্বে পেশ করা হলো কিছু গঠনমূলক প্রস্তাবনা

১)দেশের প্রতিটি পরিবার থেকেই সন্ত্রাসবাদের কুফল সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সচেতনতা তৈরী। প্রয়োজনে এ ব্যাপারে কোন দল বা সংস্থার সহযোগীতা নেয়া।

২)মসজিদ, মন্দির, গীর্জা, প্যাগোডা, সিনাগো ও গুরুদুয়ার সহ সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে সন্ত্রাসবাদের কুফল সম্পর্কে গনসচেতনতা তৈরী করা।

৩)স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে এ সম্পর্কে ধর্মীয় ও বাস্তব ভিত্তিক ব্যাখ্যা সংযোগ করা।

৪)সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রতিটি গনমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার অভিযান বাধ্যতামূলক রাখা।

৫)দল , মত, জাতি, ধম, বণ নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিককে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করা।

এ্যাডভোকেট মোঃ মহিব্বুল্লাহ শোক প্রস্তাব পেশকালে হল ভর্তি দশকদের মাঝে বিরাজ করছিল পিন পতন নিরবতা।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন ডঃ আবুল কালাম আজাদ , মোঃ আঃ লতিফ, ডাঃ মিজানুর রহমান, ডাঃ খান মনজুর, প্রফেসর কামরুন্নাহার লিপি, সাংবাদিক শেখ মহিতুর রহমান বাবলু, মানবাধিকার কর্মী কানিজ ফাতেমা, মুফতি মোঃ শহিদুল ইসলাম, মোঃ নাজমুস সাকিব, মোঃ ইসমাইল হোসেন, সুলতানা শেখ, এ্যাডভোকেট উম্মে হাবিবা,শরুফা আক্তার, আল মাহমুদ,মোঃ মহিব্বুল্লাহ, এ্যাডভোকেট মোঃ আল আমিন, ইমরান আল আজাদ, শামছুল আরেফিন হিমেল, ওসমান গনি, এলিতা পারভীন, আলিজা হাসান প্রমুখ।

বক্তারা ঈদ আনন্দ ভাগাভাগির পাশাপাশি কমিউনিটির ঐক্য, বাংলাদেশের উন্নয়ন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের সাথে প্রবাসে থেকে খুলনা বিভাগবাসীর এ সংগঠনের পক্ষ থেকে এক যোগে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার জন্য আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

বাঘ,বাঘ, সুন্দরবনের বাঘ।হল ভর্তি দশকদের চোখ হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেদিকে। আমাকে বাচঁতে দিন। আমাকে মারবেন না। বনের অবলা পশুর সে কি আতনাদ। 

অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতার দেয়াল চুরমার করে মানবাধিকার কর্মী কানিজ ফাতেমা ও সাংবাদিক শেখ মহিতুর রহমান বাবলু সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো হুংকার দিলেন।বললেন রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধীতা নয়, আমাদের প্রানের দাবী একটাই বাঁচাও সুন্দরবন, বাঁচাও পরিবেশ।

সাংবাদিক শেখ মহিতুর রহমান বাবলু বলেন, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার ভেংগে গেলে হাজার হাজার আইফেল টাওয়ার তৈরী করা সম্ভব। কিন্তু পৃথিবীর সববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট সুন্দরবন ধ্বংস হলে এটা পুনরায় তৈরী করা সম্ভব না। তিনি আরো  বলেন, সুন্দরবন শুধুমাত্র খুলনা তথা বাংলাদেশের অহংকার নয় এটা বিশ্ব সম্পদ। প্রযুক্তির এই স্বনযুগে পরিবেশ রক্ষায় সুন্দরবনের সংরক্ষন সময়ের দাবী। কোন অদৃশ্য শক্তির সুতোর টানে সুন্দরবন ধ্বংস সহ্য করা হবে না। সাংবাদিক বাবলু বিদ্যুৎ কেন্দ্র রামপাল খেকে সরিয়ে অন্যত্র করার জন্য সরকারকে আহবান জানান্ ।

ঘড়ির কাটায় রাত প্রায় ৯টা। উপস্থিত সকলেই ক্ষুধাত। অনুষ্ঠানে আগত শিশু অতিথিদের জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলার সরন্জাম ও হালকা খাবারের ব্যবস্থা আয়োজকরা প্রথম থেকেই করে চলেছেন।

সোনার গা হোটেল কর্তৃপক্ষ দেশী বিদেশী হরেক রকমের খাবার দিয়ে রাতের খাবারের জন্য বুফে রেডি করেছেন। আমার মেয়ে মাইশা তো মহা খুশী । বাংলাদেশী প্রায় সব অনুষ্ঠানেই গতবাঁধা একই ধরনের মেনু দেখে সে বিরক্ত। মাইশার মতে আজকের  মেনুতে গলদা চিংড়ি ও হরিনের মাংশ  থাকলে আরো ভালো হতো। ষোল কলায় পূণ হতো ডিনার আয়োজন। খুলনার অনুষ্ঠান বলে কথা। সে যাই হোক।

সারিবদ্ধভাবে শৃংখলার সাথে বুফে থেকে খাবার নিয়ে যে যার জায়গায় বসছে। এদিকে মঞ্চে পরিবেশিত হচ্ছে গান ও নাটিকা।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনকারী শিল্পীরা হলেন নওশাদ মাহফুজ, মোঃ শফিকুল ইসলাম, আসাদ আফজাল, ফারুক হোসেন ও শফিকুল ইসলাম রুবেল।

গোটা অনুষ্ঠান পরিচালনায় ছিলেন শাহরিয়ার কবীর ও আনিতা ইসলাম।

 ডিনার শেষ। হল কর্তৃপক্ষ বুফে গুটিয়ে ফেলেছে। কিন্তু অধিকাংশ অতিথিরা তখনও হলে। শুরু হলো এলোপাথারী নাচ গান। হল কর্তৃপক্ষ হল ত্যাগের জন্য তাগিদা দিচ্ছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা।আজ তো সবাই রাজা তাই না ? প্রবাসে এত উৎসাহ , উদ্দীপনা ও আনন্দঘন পরিবেশে খুলনাবাসীর এতবড় মিলনমেলা আগে কেউ কোনদিনও দেখে নি। সংগীতানুষ্ঠানের শেষের দিকে সুদশন বালক আইনজীবি ডলার  বিশ্বাসের মনমাতানো নাচের কথা দশকরা মনে রাখবেন অনেক দিন।

 

লন্ডন...১৪.০৮.১৬