শুভ শুভ শুভ দিন আজ মাইশার জন্মদিন।
তখন আমরা ইতালির সর্ব উত্তর প্রদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বোলছানোতে থাকি।১৯ জুন ২০০১।বিকালে কাজ থেকে বাসায় ফিরে সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছি। একটা নরম হাতের স্পর্শে ঘুম ভেঙে গেলো।
"শরীরটা ভালো লাগছে না। পেটের ব্যাথা বেড়েই চলেছে। অসহ্য ব্যাথা। চলো হাসপাতালে যাই"।বললো গিন্নি।
"অ্যাম্বুলেন্স ডাকবো না আমি ড্রাইভ করে নিয়ে যাবো "?
"এম্বুলেন্সের দরকার নেই। চল আমরা নিজেরাই যাই"।
আমরা বোলছানো হাসপাতালে পৌছালাম। সেখানে পৌঁছাতেই নার্চ পরীক্ষা করে একগাদা কাগজ পত্র এনে দিলো। বললো "এটা বচ্চা হবার ব্যাথা।সব ঠিক আছে। আসা করছি স্বাভাবিক ডেলিভারি হবে। আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টাও করে যাবো । তবে যেকোনো অপ্রত্যা শিত পরিস্থিতি সামাল দিতে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য তোমাদের অনুমতি প্রয়জন। কাগজে বিস্তারিত লেখা আছে। পড়ে দেখো একমত হলে সাক্ষর করে দাও"।
আমরা দুজনে আলোচনা করে সাক্ষর করে দিলাম।
ডেলিভারি রুমে আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো। অত্যাধুনিক রুম।জীবন সংগীর বসার যায়গাটাও বেশ। বিভিন্ন ধরণের লাইটিং। আকাশ বাতাস ফুলের গন্ধে সুরভিত। রুমটির ইন্টেরিয়র ডিজাইনে দেখে মনে হলো নতুর অতিথিকে এ সুন্দর পৃথিবীতে বরণ করে নিতে পরিকল্পিতভাবে না না সাজে সজ্জিত করা হয়েছে। লাইটিং ও সুগন্ধি পরিবর্তন করে গিন্নিকে তার পছন্দের ব্যাপারে মন্তব্য করার সুযোগ দেয়া হলো।
২/৩ জন নার্চ অবিরাম চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু ডেলিভারি হচ্ছে না।মাঝে মাঝে রুমের লাইট ও সুগন্ধিতে পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
গভীর রাতে তারা রুম পরিবর্তন করলো। সেখানে বাড়তি ছিল একটা বাথ টপ। গিন্নিকে কখনো বাথটপের কুসুক কুসুক গরম পানিতে আবার কখনো বেড এ নিয়ে নার্চরা চেষ্টা করে চলেছে। তার হাতে পায়ে বুকে বিভিন্ন যন্ত্রের সংযোর করা হয়েছে ইতিমধ্যে।
এ দৃশ দেখে দেখে আমি ক্লান্ত। হাসপাতালের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম।আধো আধো জোৎস্না প্লাবিত মায়াবী রাত। ঘুমন্ত পৃথিবীতে জেগে আছি আমার প্রথম সন্তান দেখার অপেক্ষায়।তিনটে মানুষ বিরামহীন পরিশ্রম করে যাচ্ছে।কিন্তু নতুনের দেখা নাই।মাঝে মাঝে ডাক্তার এসে দেখে যাচ্ছেন।
দেখতে দেখতে ভোর হয়ে এলো।নার্সদের চোখে মুখে উৎবিগ্নতার ছাপ। সকালের সিপ্টের নতুন ডাক্তার ও নার্চ এলো। ডাক্তার সারা রাতের রিপোর্ট দেখে আমাকে বললেন "আর দেরি করা ঠিক হবে না। রোগীর ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেছে। অনুমতি দাও তাকে ওটিতে নিয়ে যাই"।
ওরা সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অনুমতি দিতেই ওটিতে ইনফরমেশন পাঠানো হলো। মুহূর্তের মধ্যে রোগীকে অন্য ড্রেস পরিয়ে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো।
ডাক্তার আমার মনের অবস্থা বুজতে পারলেন ,কাঁধে হাত রেখে বললেন "তোমাকে ওটিতে যেতে দিতে পারছিনা বলে দুঃখিত।১৫/২০ মিনিট অপেক্ষা করো। তোমার মাইশাকে দেখতে পাবে"।
প্রবাস জীবন যে কত অভিশপ্ত তা বুঝা যায় অসুস্থ হলে, আর এ ধরণের পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে । ওটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমি বেশ শক্ত প্রকৃতির মানুষ।ইবাদতের মতো খবরের ফেরিওয়ালা হয়ে কাজ করাই আমার নেশা ।যখন যেখানে যাই নির্ভয়ে দৃঢ়তার সাথে শালুক সন্ধানীর মতো খবর সংগ্রহের চেষ্টা করেছি। কিন্তু হাসপাতালে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। পশে কেউ নেই।দিনের আলো ,রাতের অন্ধকার ভেদ করে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে। মনের বীনায় বেজে চলেছে অজানা ভয়ের সুর। বার বার ঘড়ি দেখছি। ২০ মিনিট যেন ২০ বছর মনে হচ্ছে।
হটাৎ চোখে পড়লো সাদা টাওয়ালে জড়ানো কি একটা কোলে নিয়ে একজন নার্চ দ্রুত আমার দিকে এগিয়ে আসছে।কাছে আসতেই সে মাইশাকে আমার কোলে তুলে দিল। মনে হলো আকাশের সবচাইতে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি আমার কোলে খসে পড়েছে। চোখ মুখ ও সমস্থ শরীর তার তাজা রক্তে ভেজা। শরীয়তের বিধান মতে তাকে আমি আজান শুনলাম।আস্ত একটা বিনিদ্র রজনীর সব ক্লান্ত ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল।বাবা হতে পেরেছি ভেবে আমি পুলকিত ।সেকি উপচে পড়া সূখের সৃতি। শোকর গুজার করলাম মহাম রবের দরবারে।
জল জোছনার প্রেমের শহরে জন্ম নেয়া সেদিনের সেই মাইশা ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এগোতে এগোতে বয়সী হয়ে উঠেছে। গতকাল সূর্যাস্তের মধ্যদিয়ে তার জীবনের ১৭টি বসন্ত ঝরে গেল! আজ পূর্ণ হলো ১৮ বছর। শুভ জন্মদিন মাইশা ।
পাহাড়ে ঘেরা বোলছানোর পাখির কুজন, নিশি রাতে ঝর্ণার পানির শব্দ , গাছেগাছে মিতালী, ফুল ও ফল বাগানের সৌরভ, মাটির মমতা মাখানো অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অসাধারণ সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনের ভেতর দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে মাইশার শৈশব ও কৈশোর ।খোলা বইয়ের মতো জীবনকে উন্মুক্ত রেখে এতোটা পথ হেঁটে এসেছে সে ।
গত কাল "এ " লেবেল ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হল মাইশার । সব ঠিক থাকলে আগামী সেপ্টেম্বরে সে ব্রিটেনের সনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শুরু করবে। ক্রিমিনোলজি নিয়ে লেখা পড়া করতে চায় মাইশা । গবেষণা করতে চায় মানুষ কেন ক্রাইম করে এ বিষয় নিয়ে । কত স্বপ্ন তার চোখে মুখে। ১৮ তম জন্মদিনে কামনা করি ,তার সব স্বপ্ন পূর্ণ হোক, হাজার ভিড়ের মাঝে হোক তার একটা আলাদা পরিচয়...
এই পৃথিবীটা একটা রঙ্গমঞ্চ।মানুষের মনোজগতের চেয়ে রহস্যময় পৃথিবীতে আর কিছু নেই। লোভ যদি কিছুতে থাকে সেই নির্মম সত্য হচ্ছে সুস্থভাবে স্বাধীন ভাবে আত্মমর্যাদা নিয়ে ধর্মীয় অনুভূতি বুকে ধারণ করে মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার লোভ।
সহজ জীবনটাকে কখনো কঠিন করে তুলো না "মা" ...জন্মদিনে বাবা হিসাবে এটাই আমার এক মাত্র আকুতি ....
জন্মদিন শুভ হোক ...
প্রতিদিনই জন্মদিনের মত আনন্দে পরিপূর্ণ থাকুক ! আজকের দিনটা প্রানখুলে উপভোগ কর ..শুভ জন্মদিন।
লন্ডন ২০.০৬ ২০১৯
Sheikh Mohitur Rahman Bablu ( Editor Newslife24.com)