লন্ডন থেকে জাহাঙ্গীর আলম সিকদার ঃ সাংবাদিক হিসেবে কমিউনিটির সম্প্রীতি রক্ষায় বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতি দিলো লন্ডন বারা অব টাওয়ার হ্যামলেটস। বারার স্পীকার কাউন্সিলর খালিছ উদ্দিন আহম্মেদ স্পীকার পার্লারে সাংবাদিক শেখ মহিতুর রহমান বাবলুর হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রেস্ট তুলে দেন। এ সময় তিনি বলেন একজন আপাদমস্তক সংস্কৃতিকর্মী শেখ মহিতুর রহমান বাবলু। অধুনা যিনি নতুন সৃষ্টির নেশায় সর্বদা নিভৃতচারী। অসাধারণ সব লেখা। যা আমাদের সমাজ সংস্কৃতিকে জাগিয়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। বাবলুর প্রতিটি লেখায় তথ্য, তত্ত্ব, বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনে এমন নিপুন শৈলী থাকে যা প্রবাসে জাতিগতভাবে মাথা উচু করে দাড়ানোর জন্য মাইল ফলক হয়ে থাকবে। একটু দেরিতে হলেও এমন একজন গুনি মানুষকে বারার পক্ষ থেকে সস্মানিত করতে পেরে আমি স্বস্তি অনুভব করছি।
এদিকে সম্মাননা দেয়ায় স্পীকার খালিছ-উদ্দীন কে ধন্যবাদ দিয়ে শেখ মহিতুর রহমান বাবলুর বলেন এটা আমার কাজের স্বীকৃতি। এত বড় সম্মান পাবার উপযুক্ত আমি নই। তবুও লন্ডন বারা অব টাওয়ার হ্যামলেট আমাকে এত বড় সম্মানে ভূষিত করায় আমি গর্বিত। তিনি আরো বলেন- আজকের এ সম্মাননা কমিউনিটির প্রতি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য আরো বাড়িয়ে দিলো। আগামী দিনে এই বিশাল কমিউনিটির স্বার্থে তার কলম সব সময় অবিচল থাকবে বলেও স্পীকারকে প্রতিশ্রুতি দেন সাংবাদিক শেখ মহিতুর রহমান বাবলু।
কে এই বাবলু? ১৯৮৭ সালে যন্ত্রদানব ইউরোপে প্রথম পদার্পন করেন শেখ মহিতুর রহমান বাবলু। প্রবাস জীবনের সব চাইতে বেশী সময় তিনি অতিবাহিত করেন ইতালীর সর্ব উত্তর প্রদেশ প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বোলছানোতে। ভূস্বর্গের সুইজারল্যান্ড, জার্মান, বেলজিয়াম সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে অবশেষে বাবলু ২০১২ সালে স্বপরিবারে স্থায়ীবাবে বসত গড়েন বিলেতের লন্ডনে-।
দীর্ঘ বর্ণাঢ্য প্রবাস জীবনে ইতালীতেই বাবলুর সফলতার পাখায় নতুন নতুন পালকের সংযোগ হয়েছে সব চাইতে বেশী। ২০০৫ সালের ইতালীতে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা যখন ড্রাইভিং পরীক্ষায় পাশ করে ইতালীয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবার কথা আকাশকুসুম কল্পনা ভাবতে শুরু করে, ঠিক সেই দুবিসহ মুহুর্তে, বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় বাবলু ইতালীয়ান ড্রাইভিং বই রচনা করে ইতালী সহ সমগ্র ইউরোপের বাংলাদেশীদের মাঝে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে আসেন। ২১৪ পৃষ্ঠার এই বইটির নাম দেন “ইতালীয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স এ.বি”। ইতালীয়ান সরকার অনুমোদিত এই কালজয়ী বইটির প্রকাশনার দায়িত্বে এগিয়ে আসেন খ্যাতনামা জার্মান প্রকাশক “আতেছিয়া”।
এর আগে ২০০০ সালে সুইজারল্যান্ড থেকে আন্তর্জাতিক লেখক সম্মাননা পান শেখ মহিতুর রহমান বাবলু। ইতালী থেকে প্রকাশিত সর্বাধিক জনপ্রিয় পত্রিকা “স্বদেশ বিদেশ” এর সম্পাদক মন্ডলির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। এখনো ইতালীর পাঠকেরা স্বদেশ বিদেশ এর পাতায় “খেয়াঘাট” কলামটি খোজে। তুমুল জনপ্রিয় এই কলামের লেখক ছিলেন বাবলু।
অষ্ট্রিয়া ও সুইজারল্যান্ডের কোল ঘেষা পাহাড়ে ঘেরা ইতালীর নয়নাভিরাম সুন্দর শহর বোলছালোতে স্বপরিবারে বসবাস করতেন বাবলু। প্রবাশে বড় হওয়া বাংলাদেশী ছেলে-মেয়েদের বাংলা বলা ও দেশীয় সংস্কৃতি তথা গান, বাজনা, নাচ ও আবৃত্তি শিক্ষার জন্য বোলছালোতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নজরুল বাংলা বিদ্যাপীঠ ও নজরুল স্কুল ও আর্ট।
ইতালীর ইথারে বাংলা শব্দ প্রথম ছড়িয়ে পড়ে এই গুণী মানুষটির হাত ধরে। ১৯৯৭ সালে তিনি প্রথম বোলছালোর ইতালীয়ান বেতার রেডিও ভকস এ সপ্তাহে দুঘন্টা বাংলা অনুষ্ঠান প্রচারের উদ্দোগ নেন। এর অনেক পরে জ্বলকন্যা ভেনিসের রেডিও বাজের বাংলা অনুষ্ঠান প্রচারের সূচনা লগ্নে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে বাবলু কাজ করেন লম্বা সময় ধরে।
সংগঠক হিসাবেও বাবলুর জুড়ি মেলা ভার। ১৯৯৫ সালে ইতালীর বোলছালোতে ১৬টি দেশের সদস্যদের গোপন ভোটে মাল্টিকালচারাল সামাজিক সংগঠন দি ইন্টিগ্রেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। যতদূর জানা যায় ইতালীতে ইতালীয়ান সহ বিভিন্ন দেশের মানুষ নিয়ে সেদেশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সূচনা হয় দি ইন্টিগ্রেশনের মাধ্যমে, বাবলুর নেতৃত্বে। এছাড়াও ইতালীর প্রতিটা শহরে শহীদ মিনার নির্মাণ, বড় বড় শহরের পার্ক বা খোলা জায়গা, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের নামে নামকরণ, ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা, সরকারি উদ্যোগে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন এবং ইতালীতে বসবাসরত বাংলাদেশীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তি পরীক্ষা বাংলায় নেয়া সহ বিভিন্ন কমুউনিটি সংশ্লিষ্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন বাবলু। সত্য কথা বলতে কি বাবলু কোন ব্যক্তি নয়, তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান।
১৯৬৪ সালের ১৫ এপ্রিল শিল্পনগরী খুলনায় জন্ম নেন শেখ মহিতুর রহমান বাবলু। বাবা মরহুম ডাঃ নাছরুর রহমান একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী চিকিৎসক। মা কাজি সালেহা রহমান একজন গৃহিনী । শৈশবে স্কুল জীবন থেকেই তিনি খুলনা বেতারে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। খুলনার স্বনামধন্য কসমস ক্লাবের দেয়াল পত্রিকা সম্পাদনার মধ্য দিয়ে তার লেখালিখি জগতে পদার্পণ। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাগাজিন ছাপিয়ে এক সময় তিনি জায়গা করে নেন দেশের শীর্ষ স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায়। সুইজারল্যান্ড ও ইতালীতে থাকতে দেশের প্রভাবশালী একাধিক পত্রিকার ফরেন রিপোর্টার হিসাবেও কাজ করেছেন তিনি।
২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো বিলেতে আসেন বাবলু। ২০১০ সালে এটিএন বাংলা ইউকেতে তিনি যোগ দেন এ্যাসাইনমেন্ট নিউজ এডিটর হিসাবে। এরপর চ্যানেল আই ইউকেতে ইভেন্ট ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেন। লন্ডন ও বাংলাদেশ ভিত্তিক টেলিভিশনে বিভিন্ন ধরণের টক শো ও পত্রিকা ভিত্তিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তথ্য ভিত্তিক সুবক্তা হিসাবে প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছেন বাবলু। বাংলা নিউজ, দেশ, বাংলা পোস্ট, নতুন দেশ সহ লন্ডন থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন তিনি। চ্যানেল আই লন্ডন থেকে প্রচারিত ব্যতিক্রমধর্মী সর্বাধিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান “ব্যালেন্সন্ড এন্ড হেলথি ফুড উইথ বাবলু” অনুষ্ঠানের সফল উপস্থাপক বাবলু।
সৃষ্টিকর্তার দেয়া জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিবেকের শুদ্ধ চর্চা করে প্রবাসে কমিউনিটিকে মাথা উচু করে দাড়াবার জন্য অনেক ত্যাগ করেছেন শেখ মহিতুর রহমান বাবলু। তিনি একাধারে একজন সাংবাদিক, লেখক ,উপস্থাপক, ফটোগ্রাফার, মডলে , সড়ক নিরাপত্তা ও ইতালীয়ান ফুড গবেষক। তার লেখা বই “ইতালীয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স এ.বি” আজও প্রবাসীরা অনলাইন থেকে ক্রয় করে পড়ে। ইতালী প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে এটি একটি রক্ষা কবজ। বাবলু ইতালী ছেড়ে বিলেতে পাড়ি জমালেও ইতালী প্রবাসীদের হৃদয়ে তিনি আজও অম্লান হয়ে আছেন, থাকবেন অনন্তকাল।
লেখক ঃ টিভি সাংবাদিক।