শেখ মহিতুর রহমান বাবলু :: রাজনীতির ইংরেজি “Politics”শব্দটি গ্রীক শব্দ “Politiká: Politika,” থেকে উৎপত্তি। রাজনীতি হলো এমন কিছু রাষ্ট্রের নীতি বা বিধি বিধান যে বিধান রাষ্ট্রের বা জনগনের কল্যাণে নিয়োজিত থাকে। যে নীতি প্রয়োগ করলে সমাজ ও দেশের মানুষের শুধু কল্যাণ নয় বরং সকল সমস্যার সমাধান হয় ।
আর গণতন্ত্র হল গণমানুষের মতামতের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করা। গণতন্ত্র দেশের সার্বিক উন্নয়নের একটি অংশ। উন্নয়নের স্বার্থে গণতন্ত্রের ঘাটতি মেনে নেওয়ার ফর্মুলা স্বৈরাচারের নামান্তর মাত্র। কারণ উন্নতি বলতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারও বোঝায়। এদিক দিয়ে গণতন্ত্র উন্নয়নের একটি অংশ। যদি গণতন্ত্র থাকে, তাহলে তা উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। অন্যদিকে গণতন্ত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথেও বাধা তৈরি করে না।
কোন গণতান্ত্রিক দেশে দল থাকবে এবং দলে দলে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি প্রতিহিংসা ,হানাহানি ও শত্রুতা প্রভাব বিস্তার করে তাহলে গণতন্ত্র পরাজিত হয়। জয়ী হয় সৈরশাসন।আজ বাংলাদেশে গুম, খুন ,গায়েবি মামলা, হামলা ,দুর্নীতি,দেশের সম্পদ লুটপাট ও শত্রুতার পরিবেশ আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনকে দূষিত করে তুলেছে ,যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য কল্যানকর হতে পারে না । এই অনাকাঙ্কিত পরিস্থিতি দেশের মানুষের মাঝে অজানা আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছে। দেশটা কোথায় যাচ্ছে ,দেশের রাজনীতি কোন পথে তা নিয়ে মানুষ আজ উদবিগ্ন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিতার্কিক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য বিচারবিভাগের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে প্রথমে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করলো। মহামান্য আদালত আগামী আরো দুই বার তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল রাখার সুপারিশ করলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ তা আমলে নিল না। নির্বাচনের আগে তারা আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তার অফিসে বালুর ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখলো। বিশ্ব বেহায়া বলে পরিচিত হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদকে হাপাতালে বন্দী করা হল । এতো কিছুর পরেওতারা ক্ষান্ত না হয়ে নির্বাচনের আগেই ১৫৪ জন প্রাথীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী ঘোষণা করে ক্ষমতায় থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল আওয়ামীলীগ । এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দলের শীর্ষ মন্ত্রীরা দেশের মানুষকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ,বলেছিলেন এটা সংবিধানের নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। কিন্তু নির্বাচনের পরে তারা তাদের প্রতুশ্রুতি আর রক্ষা করেন নি।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার দেশের মানুষের সামনে পুরানো বিষ নতুন লেবেল লাগিয়ে বাজারজাত করলো । দেশ নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠালো । স্বৈরাচার এরশাদকে প্রথমে হাসপাতালে পরে দেশের বাইরে পাঠানো হল । এবার আর ১৫৪ টি আসন বিনাভোটে বিজয়ী না করে ই ভি এম এর মাধ্যমে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ সিট নিশ্চিত করার ফাঁদ পাতলো আওয়ামীলীগ ।কিন্তু শেষ মুহূর্তে চীনা কোম্পানি এতোগুলো ই ভি এম যন্ত্র দিতে অপারগতা জানালে দলটি তাদের কৌশলে পরিবর্তন আনে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করা হলো ,অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধ করা হলো ,দেশের ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেয়া হল ,নির্বাচনের দিন যানবাহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হল ,বিদেশী নির্বাচন পরিদর্শকদেরকে ভিসা দিতে গড়িমসি করা হল ,আর যারা নির্বাচনের দিনে পরিদর্শন করবেন তাদেরকে মূর্তিরমতো দাঁড়িয়ে থাকার শর্ত জুড়ে দেয়া হলো । পুলিশ ও সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তা মাঠে নামিয়ে দিল নৌকার পক্ষে ভোট চাইতে। আওয়ামীলীগ নির্বাচনে জিতলে তাদেরকে বিশাল অংকের নগদ অর্থ দেবার প্রতুশ্রুতি মিললো । ইসলামিক শাসনতন্ত্র আন্দোলনকে ৯০ কোটি টাকা দিয়ে ৩০০ আসনে নির্বাচনের সুযোগ করে দেয়া হলো । এবারের নির্বাচনে মহাজোট থেকে ২৯টি আসন পেলো জাতীয় পার্টি। এর বাইরে আলাদাভাবে আরও ১৪০টি আসনে উন্মুক্ত প্রার্থী রাখার কথা জানানো হলো । মহাজোট থেকে বলাহল ধানের শীষ ঠেকাতেই এই প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জনসভায় ও বাড়ি বাড়ি গিয়ে আওয়ামী পেটোয়া বাহিনী বিরোধী দলকে ভয় ভীতি দেখালো । প্রকাশ্যে গণমাধম কর্মীদের উপর নির্যাতনের পাহাড় তুলে দেয়া হলো । উদ্দেশো একটাই ভয় দেখানো। প্রতিপক্ষকে বিব্রতকর বা বেসামাল অবস্থায় ফেলে , দেশ ব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা।
রাজনীতির এসব অপকৌশলে সাময়িকভাবে কোন দল লাভবান হলেও শেষ পর্যন্ত তা আর টিকে থাকে না। বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগ সহ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে, সারাজীবন ক্ষমতায় থাকার জন্য বাকশাল কায়েম করেছিলেন। সরকারের নিয়ন্ত্রণে ৪ টি পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করা হয়েছিল । সরকারি কর্মচারী কর্মকর্তারা বাকশালে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিল । রক্ষী বাহিনীর সেদিনের তান্ডবের কথা মনে পড়লে আজো দেশের মানুষ শিউরে ওঠে। । হাজার হাজার জাসদের নেতা কর্মী হত্যা করা হল । এত কিছুর পরেও বঙ্গবন্ধুর শেষ রক্ষা হয়নি। এটাই বাস্তবতা। এটাই প্রকৃত ইতিহাস।
ক্ষমতাসীনদেরকে মনে রাখতে হবে ৭২-৭৫ এ হাজার হাজার জাসদের নেতা কর্মী নির্মম ভাবে হত্যা করেও বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে এই ক্ষুদ্রতম দলটি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। যারা নির্বাচনে কোনোদিন তাদের জামানত রক্ষা করতে পারে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এতো বড় ট্রাজেডির পরেও আওয়ামীলীগ শেষ হয়ে যায়নি। ১৯৮০ সালের ৩১ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যার পর বি এন পি আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জামাতের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি কার্যকর করলেও আজো জামাত আওয়ামীলীগ ও ভারতের জন্য সবচাইতে বড় হুমকি। আওয়ামীলীগ ও ভারত বাংলাদেশের কোন দলকে ভয় পেলে তার নাম জামাত। কোন ব্যাক্তিকে ভয় পেলে তার নাম বেগম খালেদা জিয়া ও দেশ নায়ক তারেক জিয়া । এটাই রাজনৈতিক বাস্তবতা। হত্যার রাজনীতি দিয়ে কোনো দলের রাজনীতি শেষ করা যায় না। বরং ক্রোধের জন্ম দেয়। যা একটা জাতির জন্য ভয়ঙ্কর।
বাংলাদেশের নিরীহ জনগণ মনে করেন জাতিসংঘ বা পশ্চিমারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষায় ভূমিকা রাখবে। এটা ভুল ধারণা। বিশ্বব্যাঙ্ক ,আইএমএফ,জাতিসংঘ এরা সবাই পশ্চিমাদের বি টিম। পশ্চিমারা যা বলে এই সংস্থা গুলো তাই করে। পশ্চিমারা নিজের দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় যতটা তৎপর ,তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্র ধ্বংসে তার চাইতে তারা বেশি তৎপর। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে পশ্চিমারা কারণে অকারণে নাক গলায়। এটা তাদের অনধিকার চর্চার নামান্তর মাত্র। মাঝে মাঝে বিবৃতি ও হুঙ্কার দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে যে তারা বিশ্ব মোড়ল। মধপ্রাচ্য ও স্ক্যানডিভির কয়েকটি দেশ ছাড়া উন্নত বিশ্বের দেশগুলি তৃতীয় বিশ্বকে যে অনুদান বা কর্জ দেয় ,সেখানে থাকে কঠিন শর্ত। যা সাধারণ মানুষ কোনোদিনও জানতে বা বুঝতে পারে না। পশ্চিমারা আমাদের কতটুকু মঙ্গল চায় তার জন্য বার্মার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কথা ভাবলেই পরিষ্কার হবার কথা। সুতরাং ভরসা তাদের উপর নয় ,ভরসা করতে হবে নিজেদের উপর দেশের মানুষের উপর।
বিগত ১০ বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ উন্নয়নের খালি কলসি বাজিয়েছে বেশি। দেশের গণতন্ত্র ও প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস ,বিরোধীদল দমন ,প্রতিবেশী ভারতের তোষামোদি ও লুটপাটের রাজত্ব কায়েম ছাড়া কাজের কাজ কিছুই করেনি। সত্যিকারার্থে দেশের উন্নতি হলে তাদের এতো ভয় কিসের। কেন জনগণের উপর আস্থা নেই তাদের। ক্ষমতা ছেড়ে নির্বাচন দিতে কেন এত অজুহাত। সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ প্রসারিত করতেও তারা এতো ভীত কেন।তার মানে সবই উন্নয়নের ফাঁকা আওয়াজ। এরা দেশের মানুষকে বোকা ভাবে ,নিজেদেরকে ভাবে মহা বুদ্ধিমান।
সেদিন দেখলাম আওয়ামী একজন সংসদ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে বলছেন দেশের ৯০ ভাগ মানুষ আওয়ামীলীগের বিপক্ষে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ১০ ভাগের বেশি ভোট আওমিলিগ পাবে না। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ সহ বিশ্বের বড় বড় সংস্থার জরিপে আওয়ামীলীগের জনসমর্থন দেশের মোট জনসংখ্যার ১৪ ভাগের বেশি নয়।
৪ কোটি ৮২ লাশ বেকারের দেশ বাংলাদেশে ৯ লক্ষ বিদেশী কর্মরত কেন ? বর্তমানে বাংলাদেশে অবৈধ ভারতীয় কর্মরত নাগরিকের সংখ্যা কত ? কার স্বার্থে দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থার মেরুদন্ড ভেঙে ফেলা হল ? বিগত ১১ বছরে দেশের ৬৫ বিলিয়ন ডলার পাচারের নেপথ্য কথা কি ? মাথাপিছু ঋণের পরিমান ৬০ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেল কেন ? পিলখানা ট্রাজিডি ,শাপলাচত্বরে রক্তের হলিখেলা ,শেয়ার বাজার লোপাট ,বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা চুরি,রিজার্ভ চুরি ,কয়লা ও পাথর চুরি ,১০ বছরে গুম ৬,৬৬০ ,খুন ৩৮০০০ ,ধর্ষণ ১৯৭২০ ইত্যাদি প্রশ্নের জবাব ক্ষমতা হারালে আওয়ামীলীগকে দিতে হবে। এসব কথা মাথায় রেখে নির্বাচনের আগেই দলটির শীর্ষ নেতারা তাদের নেতাকর্মীদেরকে বিভিন্ন সময় হুশিয়ার করে দিয়েছেন। বলেছেন দল ক্ষমতা হারালে তাদের অবস্থা বার্মার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাইতেও খারাপ হবে।
সুতরাং ১১ তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাথী ,নেতা কর্মী,সাধারণ ভোটার ও গোটা দেশবাসীর মধ্যে সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জাতীয় ঐক্যমত গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবি। দেশে যদি আরো গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থা ভেঙে পড়ে তাহলে জাতি এক চরম ও অনাকাঙ্কিত বিপর্যয়ের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। সতরাং জাতীয় জীবনের এই চরম ও পরম দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে বিগত ১০ বছর পর আপনাকে একটি দিন দেশকে দিতে হবে। সেটি হলো ৩০ ডিসেম্বর। এদিন সকাল সকাল দলে দলে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে আপনার পছন্দের প্রাথীকে ভোট দিন। চোর ডাকাতদের হাতথেকে কেন্দ্র রক্ষা করতে সারাদিন ভোটকেন্দ্র পাহারা দিন। সরকারকে বুঝিয়ে দিন তোমাদের কত পুলিশ ,কত RAB কত সেনাবাহিনী ও কত পেটোয়া বাহিনী আছে আমরা দেখতে চাই। আমি এদেশের মানুষ। এটা আমার দেশ। আমি এদেশের মালিক। আমার মায়ের সমতুল্য দেশকে নিয়ে ছিনি মিনি খেলা আর আমরা সহ্য করবো না।
লেখক : Editor -Newslife24.Com
Publisher 29 December 2018 Newslife24.com